আমন্ত্রিত ৩০ শিক্ষাবিদ ১৭ জনই যাননি

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে কোনো আগ্রহ বা আস্থা না থাকার কথা শুরু থেকেই বলে আসছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও জোট। দায়িত্ব নেওয়ার ১৫তম দিনেই একধরনের ‘আস্থাহীনতার’ মুখে পড়তে হয়েছে নতুন ইসিকে। দেশের ৩০ জন শিক্ষাবিদকে ইসি তাদের প্রথম সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৩ জন গতকাল রোববারের সংলাপে অংশ নিয়েছেন।

আর সংলাপে অংশ নেওয়া শিক্ষাবিদেরা সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাঁরা বলেছেন, ইসিকে কাজের মাধ্যমেই আস্থা অর্জন করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে ইসির অধীনে আনা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, ভোটারদের সচেতন করা, বিরোধী দলগুলোকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়াসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।

কাজী হাবিবুল আউয়াল
দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি সমঝোতা না থাকলে, পক্ষগুলো খুব বেশি বিবদমান হয়ে গেলে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা দুরূহ।
কাজী হাবিবুল আউয়াল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার

কেউ কেউ বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি।
এসব পরামর্শের বিপরীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আবারও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে, একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। বড় দল নির্বাচন থেকে দূরে থাকলে অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে।
সংলাপ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁরা ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনেকের সমস্যা থাকা স্বাভাবিক। অংশগ্রহণ আরও বেশি হলে তাঁরা খুশি হতেন। তিনি বলেন, দলীয় ও নির্দলীয় সরকার নিয়েও সংলাপে বক্তব্য এসেছে। তবে নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় সরকার লাগবে—এমন বক্তব্য সবাই দেননি। দু–একজন হয়তো এ ধরনের বলেছেন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এই সংলাপ হয়। সভাকক্ষের বাইরে টিভি মনিটরে আলোচনা সরাসরি দেখা ও শোনার ব্যবস্থা ছিল সাংবাদিকদের জন্য। সংলাপে সিইসির সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। সংলাপে ইসির পক্ষ থেকে সেভাবে সঞ্চালকের ভূমিকায় কেউ ছিলেন না। কার পরে কে বক্তব্য দেবেন, সেটিও ঠিক করে দেননি কেউ। শিক্ষকেরা নিজেদের মতো করে একজনের পর একজন বক্তব্য দিয়েছেন।
‘গালি খেতে হবে’

সংলাপে অংশ নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আপনারা যত যত্ন করেই কাজ করেন না কেন, আমি শিউর (নিশ্চিত) গালি খেতে হবে। লোকজন অনেক কিছু বলবেই। তবে দিন শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি আপনারা বলতে পারেন আমি অনেস্ট (সৎ) ছিলাম, কাজটা সঠিক করেছি। তাহলে কে কী বলেছে, তা মাইন্ড করবেন না, তাহলেই হবে।’

মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার
ভোটের বাক্সেরও একটা খাওয়ার সময় আছে। সেটা সকাল ৮টা। কী হয়েছে লাস্ট ইলেকশনে? সে তো সাহ্‌রি খেয়েছে। সে তো ব্রেকফাস্ট খায়নি।
মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার,অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ভোটের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্যাতনের শিকার হন। তাঁদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে মানুষের ভোগান্তি দূর করতে উদ্যোগী হওয়ারও আহ্বান জানান।

দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার। এই নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, অনুসন্ধান কমিটি ১০-২০ জনের নাম প্রকাশ করলে ভালো হতো। এখন যেভাবে কমিশন হয়েছে, তা লুকোচুরি, ছলচাতুরী ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে, এমনটি বলা যায়।
অধ্যাপক ইয়াহ্‌ইয়া আখতার বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাচ্ছে না, এটা একাধিকবার দেখা গেছে। ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তার আগে গণভোট করতে হবে। মানুষ যদি চায় তাহলে এটি ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, ভারতে অনেক জায়গায় ইভিএম নিয়ে মামলা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি অঙ্গরাজ্য ইভিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ইয়াহ্‌ইয়া আখতার বলেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একটা খাওয়ার ওয়াক্ত আছে। আপনি সকাল আটটার সময় খেলে এটাকে ব্রেকফাস্ট বলতে হবে। একটার সময় খেলে সেটাকে ব্রেকফাস্ট বললে হবে না, লাঞ্চ বলতে হবে। ভোটের বাক্সেরও একটা খাওয়ার সময় আছে। সেটা সকাল আটটা। কী হয়েছে লাস্ট ইলেকশনে? সে তো সাহ্‌রি খেয়েছে। সে তো ব্রেকফাস্ট খায়নি। এ রকম নির্বাচন করলে হবে না। এ রকম নির্বাচন আমরা চাই না।’

সাবেক আমলানির্ভর বর্তমান কমিশন কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আপনাদের (ইসি) তিনজন আমলা। আপনারা সরকারের সুবিধাভোগী। আপনারা কীভাবে সরকারের বিরাগভাজন হবেন। এখানে চক্ষুলজ্জারও বিষয় আছে।’
ইভিএম আরও সংস্কার করার সুযোগ আছে বলে সংলাপে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম আনোয়ার হোসেন।

গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি বলে মত দেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আবদুল মান্নান চৌধুরী।

নির্বাচন কমিশনকে কাজের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ইসিকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। ক্ষমতাসীন দল আর প্রশাসনকে এক করা যাবে না। প্রয়োজনে একাধিক দিনে জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
একটি বড় রাজনৈতিক দল প্রায় সবকিছুতে ‘না’ বলছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে তাদের জন্য ‘স্পেস’ করে দিতে হবে। বারবার তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের প্রতিনিধি হিসেবে সংলাপে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ–উপাচার্য নিয়াজ মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার সংকট আছে। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনবিমুখতা তৈরি হয়েছে।

এর আগে সংলাপের শুরুতে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিভিন্ন কারণে হয়তো পুরো অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তাঁরা চান আগামী নির্বাচন যেন অধিক অংশগ্রহণমূলক হয়। সংলাপের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন করাটা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচনে রাজনৈতিক আবহ অনুকূল না হলে, দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি সমঝোতা না থাকলে, পক্ষগুলো খুব বেশি বিবদমান হয়ে গেলে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা দুরূহ। রাজনৈতিক সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ। সমঝোতা হলে ইসির কাজ সহজ হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভোটের তিন মাস আগে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনা প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, এটা বোধ হয় পুরোপুরি আনা হয় না। এটা হয়তো ইসিকে আইনিভাবে ক্ষমতা দেওয়া আছে সীমিতভাবে করার।

ইভিএমের ব্যবহার প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ইভিএম নিয়ে তাঁরা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন, এখানে সমস্যা আছে কি না।

বেলা তিনটা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ সংলাপে অন্যদের মধ্যে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম মফিজুল ইসলাম, অধ্যাপক এম আবুল কাশেম মজুমদার, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, অধ্যাপক লায়লুফার ইয়াসমীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান সংলাপে অংশ নেন।

আমন্ত্রণ পেয়েও যাননি যাঁরা

ইসি আয়োজিত প্রথম সংলাপে আমন্ত্রণ পেয়েও অংশ নেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আখতারুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলাম, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম, ইউল্যাবের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, আসিফ নজরুল, মোহাব্বত খান, মোবাশ্বের মোনেম, ফেরদৌস হাসান ও তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল ইসলাম।

তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত কাজ থাকায় সংলাপে অংশ নিতে পারবেন না বলে আগেই ইসিকে জানিয়েছিলেন। আর আমন্ত্রিতদের মধ্যে দুজন ছিলেন দেশের বাইরে।

তবে সংলাপে আমন্ত্রিত তিনজন অধ্যাপক গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা মনে করছেন, এই সংলাপে অর্থবহ কিছু হবে না।

এদিকে সংলাপে আমন্ত্রিত ৩০ জনের মধ্যে ১৭ জনের অংশ না নেওয়ার বিষয়টিকে ইসির জন্য শুরুতেই হোঁচট হিসেবে দেখছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের আরও প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল। গত দুটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করে কী কী সমস্যা তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন ছিল। সংলাপের আগে দু-একটি নির্বাচন এবং কিছু কাজের মাধ্যমে তাদের এটি প্রমাণ করতে হতো যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। গতানুগতিক সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না।

নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইসির অধীনে আনার বিষয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, এ বিষয়ে আইনি কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। ইসির অধীনে আনা হলেও কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। গত নির্বাচনে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে এবং প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল না।