আয়েশে আ.লীগের নেতারা

জেলায় দলে প্রকাশ্য কোনো বিভাজন কিংবা কোন্দল নেই। তবে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগে ছয়টি বলয় আছে।

সিলেটে বিরোধী দলগুলোর দীর্ঘদিন ধরে কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে আওয়ামী লীগও দলীয়ভাবে মাঠে সরব নয়। অবশ্য দলীয় কিছু কর্মসূচি আর জাতীয় দিবস পালনের দায় আছে। পাশাপাশি হঠাৎ চলে আসে কোনো স্থানীয় নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন। তখন নেতা-কর্মীদের তৎপরতা চোখে পড়ে। ফলে আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

প্রায় দেড় বছর ধরে এই চিত্র সিলেটের। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, অতীতে বিরোধী পক্ষের কর্মসূচির বিপরীতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ছিল। আবার একটা সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন ডাকসাইটে দুই নেতার পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধারায় বিভক্ত। কেউ প্রয়াত নেতা আবদুস সামাদ আজাদের, কেউ অপর প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বলয়ে থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতেন। দলের ভেতরে ছিল নানা উপবলয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। দলের ভেতরে নানা বলয়ে নেতা-কর্মীরা বিভক্ত থাকলেও দলীয় কর্মসূচি পালনের সময় বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হন তাঁরা। ফলে ফুরফুরে মেজাজে আছেন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, টুকটাক কিছু কর্মসূচি ছাড়া দলীয় কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা চলছে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এলে স্থানীয় পর্যায়ে তৎপরতা বাড়ে। তাঁরা যতক্ষণ থাকেন, নেতা-কর্মীরা ততক্ষণ একটু সরব থাকেন। তাঁরা চলে গেলে আবার সবাই চুপ। অবশ্য চলতি বছর দলীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন ঘটা করে পালন করায় কর্মী-সমর্থকেরা উচ্ছ্বসিত।

আয়েশে নয়, আমরা নানা কাজে সরব আছি। দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি নিয়মিত কর্মিসভাও করছি।
জাকির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, মহানগর আ. লীগ

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘আয়েশে নয়, আমরা দলীয়ভাবে নানা কাজে সরব আছি। কেন্দ্র থেকে নির্দেশিত দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি নিয়মিত কর্মিসভাও করছি। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের মানবিক সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত আছে।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। লুৎফুর রহমান ও নাসির উদ্দিন খান যথাক্রমে জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে মহানগর কমিটিতে মাসুক উদ্দিন আহমদ সভাপতি ও জাকির হোসেন সাধারণ সম্পাদক হন। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি হয় ৭৫ সদস্যবিশিষ্ট। ২ সেপ্টেম্বর জেলা কমিটির সভাপতি লুৎফুর রহমান মারা যান। ৬ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী।

দলে কোনো বিভাজন কিংবা অন্তঃকোন্দল নেই। ঐক্যবদ্ধভাবে দলকে এগিয়ে নিতে সবাই সচেষ্ট আছেন।
শফিকুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জেলা আ. লীগ

নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘একটা সময়ে বিএনপি-জামায়াত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি দিয়েছিল। তখন আমরা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থেকে সেসব অপতৎপরতা প্রতিহত করেছি। এখন যেহেতু এ ধরনের অপতৎপরতা কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, তাই রাজপথে আমাদেরও কর্মসূচি নেই। তবে দলীয়ভাবে নানা কর্মসূচি নিয়ে আমরা ঠিকই মাঠে আছি।’

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সিলেটে দলে প্রকাশ্য কোনো বিভাজন কিংবা কোন্দল নেই। তবে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগে ছয়টি বলয় আছে। এগুলোতে নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিৎ সরকার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান ও বিধান কুমার সাহা।

ওই ছয় বলয়ের পাশাপাশি সিলেট মহানগর ও জেলায় আরও দুটি বলয় সক্রিয় আছে। এটি তৈরি হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে। যাঁদের নামে এসব বলয় পরিচিতি পেয়েছে, তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। দুজনই বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

বলয়ভিত্তিক রাজনীতিতে যুক্ত কয়েকজন জানিয়েছেন, সিলেটে সংসদীয় আসন ছয়টি। বিগত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ হন গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান। এর বাইরে বাকি পাঁচটি আসনেই নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। সিলেট-৩ আসনের সাংসদ ছিলেন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। তিনি মারা গেলে সম্প্রতি উপনির্বাচনে সাংসদ হন হাবিবুর রহমান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে এ কে আব্দুল মোমেন (পররাষ্ট্রমন্ত্রী), সিলেট-৪ আসনে ইমরান আহমদ (প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী), সিলেট-৫ আসনে হাফিজ আহমদ মজুমদার এবং সিলেট-৬ আসনে নুরুল ইসলাম নাহিদ (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী) জয় লাভ করেন। এই চারজন সিলেটে বলয়কেন্দ্রিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় নেই। তবে আব্দুল মোমেন ও নুরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত কয়েকজন বলয়ভিত্তিক রাজনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকায় আছেন।

তবে জেলায় বলয়ভিত্তিক কোনো রাজনীতি নেই বলে দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, তৃণমূল থেকে শুরু করে কোথাও দলে কোনো বিভাজন কিংবা অন্তঃকোন্দল নেই। ঐক্যবদ্ধভাবে দলকে এগিয়ে নিতে সবাই সচেষ্ট আছেন। ছাত্রলীগ বা অঙ্গসংগঠন ঘিরে কিছু বলয় থাকতে পারে। তবে মূল দল আওয়ামী লীগে কোনো বলয় নেই। দলে বিভেদ বা মতভেদের কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না।