আ.লীগের সঙ্গে ইসলামি দল বেশি

>
  • প্রচলিত ধারণা, ইসলামপন্থী দলের ভোট বিএনপির দিকে বেশি যায়
  • ইসলামপন্থী ভোটব্যাংকের দিকে নজর আ. লীগ ও মিত্র জাতীয় পার্টির
  • এবার ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় ৭০টি ইসলামি দল ও সংগঠন
  • ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে
  • ৩২টি দল আছে জাপার সঙ্গে, যারা ভোটে সরকারের সহায়ক হবে
  • বিএনপির সঙ্গে আছে ৫টি ইসলামি দল

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটের মাঠে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর তৎপরতা। এসব দলের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং এর মিত্র জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। একসময় বিএনপির ঘনিষ্ঠ ইসলামি দলও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মিত্রতা গড়েছে।

এবার ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় আছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৭০টি ইসলামি দল ও সংগঠন। এর মধ্যে ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ৩২টি দল আছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে, যারা ভোটের মাঠে সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। আর বিএনপির সঙ্গে আছে ৫টি দল।

অনেক দিন ধরে একটা ধারণা আছে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভোট বিএনপির দিকেই বেশি যায়। এবার এই ‘ভোটব্যাংকের’ দিকে নজর দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং এর মিত্র এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরই অংশ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও সরকার সখ্য গড়ে তোলে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ইসলামপন্থীদের বেশি করে কাছে টানা গেলে বিএনপির ভোট কমবে, এই কৌশল থেকে ছোট-বড় সব ধরনের ধর্মভিত্তিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিদের সঙ্গে গত পাঁচ বছর সরকার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে নির্বাচনী সমঝোতা করছে।

তবে দুটি দল—চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ) এখন পর্যন্ত কোনো দিকে যায়নি। তবে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ তার আগে-পরে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সরকার কিছুটা নমনীয় ছিল। বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলন গত ১০ বছরে সারা দেশে ওয়াজ মাহফিলসহ নির্বিঘ্নে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে। চরমোনাই পীরের অনেক মাহফিলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ ও প্রভাবশালী নেতাদের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকতে দেখা গেছে।

অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সময় আমরা সভা-মাহফিলের যে সুযোগ পাই, তা না। বিএনপি, জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করে। তবে আমাদের প্রতি সরকারের একটা সুনজর থাকতে পারে এ কারণে যে আমরা হাঙ্গামা করি না। প্রশাসন আমাদের ঝুঁকি মনে করে না।’ তিনি বলেন, ‘সাময়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকে অন্য জোটে যাচ্ছে। আমরা জোট, নোট, চোট এগুলোকে সতর্কভাবে এড়িয়ে চলছি।’

সরকারের সমর্থনে নতুন নতুন জোট
সর্বশেষ সম্মিলিত ইসলামী জোট নামে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয় ৩ নভেম্বর। এই জোটের শরিক দল আটটি। এই জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দীর্ঘদিন প্রয়াত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ওই দলের মহাসচিবের পদ হারান। এরপর তিনি খেলাফত আন্দোলনের একাংশ নিয়ে নতুন দল করেন। এত দিন তাঁর অবস্থান ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। চলতি মাসে জাফরুল্লাহ খান আটটি অনিবন্ধিত সংগঠন নিয়ে সম্মিলিত ইসলামী জোট গঠন করেন। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করতে চায়। জোটের নেতারা গত শুক্রবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকের বিষয়ে সম্মিলিত ইসলামী জোটের কো-চেয়ারম্যান মুফতি ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১০টি আসনের প্রার্থী তালিকা দিয়েছি। ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাদের জানাবেন।’

মুফতি ফখরুলও খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। এখন তিনি বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলন নামে নতুন দল গঠন করেছেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি দল নিয়ে সরকারের সমর্থনে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ) নামের আরেকটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান লক্ষ্মীপুর-১ আসনের তরীকত ফেডারেশনের সাংসদ এম এ আউয়াল। এই দুজন দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। এই জোট সাতটি আসন চেয়ে সরকারের কাছে তালিকা দিয়েছে।

এম এ আউয়াল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), সাইফুদ্দীন মাইজভান্ডারীর দল সুপ্রিম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করে জোট পুনর্গঠন করছি। আশা করছি পাঁচ থেকে সাতটি আসন পাব।’

শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও মুফতি রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন খাদেমুল ইসলাম সরাসরি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। মুফতি রুহুল আমিন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শুকরানা সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন।

মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলেম-ওলামাদের একটি দূরত্ব ছিল। এবার বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাসনদের সরকারি স্বীকৃতির প্রভাব ইসলামপন্থীদের ওপর পড়েছে।’

নিবন্ধিত ২টি বিএনপি ও ৬টি আ.লীগের সঙ্গে
নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। এর মধ্যে ইসলামপন্থী দল ১০টি। এর মধ্যে ছয়টিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন (নজিবুল বশর) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে, আর ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ) মহাজোটের শরিক। বাকি চারটি দল ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) ও জাকের পার্টির (মোস্তফা আমীর) সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে আছে দুটি দল—খেলাফত মজলিস (ইসহাক) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (আবদুল মোমেন)। নিবন্ধিত বাকি দুটি ইসলামি দল ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ) কোনো দিকে যায়নি এখনো।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে কোন উদ্দেশ্যে জোট পরিবর্তন করেছেন, নতুন নতুন ঘনিষ্ঠতা তৈরি করছেন, এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষ অনেক সচেতন। আদর্শ বদল করে নিজের চাওয়া-পাওয়ার জন্য যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের কথায় মানুষ ভোটের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে বলে মনে করি না।’

তিন অবস্থায় বড় তিন দল
নিবন্ধিত দলের বাইরে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে বড় দল জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ) বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে আছে।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই পীর) ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এবার ইসলামী ঐক্যজোটের এই অংশ বিএনপির সঙ্গে নেই। জামায়াত নিবন্ধন ও প্রতীক হারিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন স্বতন্ত্র অবস্থানে আছে।

এর মধ্যে প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী) ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সমর্থনে আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে প্রার্থী করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অবশ্য ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী দাবি করেন, আসন নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনো সমঝোতা হয়নি। সে চেষ্টাও তাঁরা করেননি।

আর প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মান্নান) সঙ্গে সরকারের সখ্য আছে। সম্প্রতি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে দল দুটি নির্বাচনী জোট করেছে। শায়খুল হাদিসের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে ছিল। সেখান থেকে বের হলে ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল। পরে বিতর্কের মুখে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি বাতিল করে।

হেফাজতের একাংশ সরকারের মিত্র
অতীতে ইসলামি দলগুলোর বড় একটি অংশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে সক্রিয় থাকত। এর ফল পেত বিএনপি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইসলামি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, এখন দলগুলোর মধ্যে বিভক্তিও বেড়েছে। কিছু দলের ওপর সরকারের চাপ ও নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার খড়্গ ঝুলছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সরকার কওমি মাদ্রাসার আলেমদের একটা অংশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বাড়িয়েছে।

২০১৩ সালের ৫ মে উত্থান ঘটা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের একটি অংশও সরকারের সঙ্গে আছে। হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী, তাঁর ছেলে আনাস মাদানিসহ সংগঠনের একটি অংশের সঙ্গে সরকারের সখ্য আছে। এ নিয়ে হেফাজতের আরেকটা অংশ ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তার শাপলা চত্বরের ঘটনার ব্যাপারে কিছু বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

অবশ্য হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম নির্বাচন করবে না, কাউকে মনোনয়ন দেবে না এবং কাউকে সমর্থনও করবে না। তবে তিনি বলেন, ‘ভোট প্রত্যেকের নাগরিক অধিকার। আমাদের নেতৃবৃন্দ, কর্মী-সমর্থকেরা যারা ইসলামের পক্ষে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে; তারা নিজেদের বুদ্ধি, বিবেক সামনে রেখে ভোট প্রয়োগ করবে। আমরা কাউকে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা দেব না।’

ইসলামিদের নিয়ে এরশাদের জোট
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ‘সম্মিলিত ইসলামী মহাজোট’ নামে একটি ৩৪-দলীয় মোর্চার সঙ্গে জোট করেন। তাঁর এই জোট গঠন সরকারকে সহায়তার লক্ষ্যে বলে প্রচার আছে। এরশাদের জোটের দুটি দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন আছে। দল দুটি হলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান)। বাকি দলগুলো অপরিচিত ও নামসর্বস্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিবন্ধিত যেসব দল ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আছে, তারা সব সময় সরকারের সঙ্গেই ছিল। আর যেসব দল দিয়ে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, তারা ঘুরে বেড়ানো দল। এসব দলের ক্ষমতা কী, সব মিলিয়ে ওদের সংখ্যা কত, নির্বাচনে তারা কী আর প্রভাব ফেলবে।