ইসি গঠন নিয়ে ১৪–দলীয় জোট সক্রিয় হচ্ছে

সমঝোতার ভিত্তিতে ১৪–দলীয় জোটের শরিক দলগুলো থেকে সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করা হবে।

নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটকে আবার সক্রিয় করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। মূলত নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ১৪ দলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রকাশ করতে চায় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে জোটের শরিক দলগুলো থেকে সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করা হবে। ১৪-দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং অন্য শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখেনি আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে জোটে মান-অভিমানের পাশাপাশি কিছুটা অসন্তোষও রয়েছে। এরপর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে এবং জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের ছাড় দেওয়া
হয়নি। এসব বিষয়েও শরিকদের মধ্যে হতাশা আছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ১৪ দলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও খুব একটা হয়নি। করোনা মহামারির সময় দিবসভিত্তিক কিছু ভার্চ্যুয়াল আলোচনা ছাড়া তেমন কার্যক্রমও ছিল না। ফলে শরিকদের অনেকেই ১৪-দলীয় জোটকে ‘নিষ্ক্রিয়’ বলেই ধরে নিয়েছেন।

৫ অক্টোবর ১৪ দলের বৈঠক ডেকেও তা বাতিল করা হয়েছে। শিগগিরই বৈঠক ডাকা হবে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। মূলত এই বৈঠকে শরিকদের মান ভাঙানোর পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে কীভাবে জোটগতভাবে ভূমিকা রাখা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করা।

১৪-দলীয় জোটের অন্যতম দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, জোট এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই বৈঠক হবে। তিনি জানান, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের নিজস্ব বক্তব্য আছে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে মানুষের হতাশা আছে। এই বিষয়গুলো জোটের বৈঠকে তোলা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও জোটের আগামী বৈঠকে তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি।

আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ২০১৭ সালে সর্বশেষ যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল, পরবর্তী কমিশন সেভাবেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আগেরবার প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। এরপর বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের (তখন তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন) সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাঁচটি করে নাম চায়। এরপর তারা ১০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠায়। রাষ্ট্রপতি কে এম নূরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও চারজন কমিশনার নিয়োগ দেন। অন্য কমিশনাররা হলেন মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাৎ হোসেন।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা আছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ১৪-দলীয় জোটের আগামী বৈঠকে তুলে ধরা হবে।
রাশেদ খান মেনন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি

২০১৭ সালে গঠিত কমিশনের পাঁচ সদস্যের মধ্যে ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের তালিকা থেকে তিনজন স্থান পান। সিইসি নূরুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছিল তরীকত ফেডারেশন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চাইলে আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে নিয়ে একসঙ্গে সাড়া দেবে।

জোটভুক্ত বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার তাঁরা আওয়ামী লীগের সব চাওয়া সহজেই মেনে নিতে রাজি নন। তিনটি শরিক দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, জোটের বৈঠকে ইসি গঠনের প্রসঙ্গ এলে আইন প্রণয়নের বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনব্যবস্থায় অনিয়ম এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টিও তোলা হবে। কারণ, ২০০৫ সালে ১৪ দলের পক্ষ থেকে ৩৩ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেখানে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা আছে। এখন বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জোটে পুরোপুরি সংহতি আছে, এটা বলা যাবে না। তবে আদর্শিক জোট হিসেবে প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে জোট আবারও সক্রিয় হবে। তবে তাঁরা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ইসি গঠনের বিষয়ে জোর দেবেন।

নির্বাচনে ছাড় পাচ্ছে না শরিকেরা

সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর) আসন থেকে তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বাসদের একাংশের সভাপতি রেজাউর রশীদ খান। ১৪-দলীয় জোটে যোগ দেওয়ার পর আর ভোট করতে পারেননি তিনি। আওয়ামী লীগের সাংসদ হাসিবুর রহমান মারা যাওয়ার পর এই আসন থেকে জোটের সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো আশ্বাস পাননি।

১৪ দল সূত্র জানায়, শরিক দলের কেউ কেউ রেজাউর রশীদকে নিজ দলের হয়ে একা লড়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি আর সাহস করেননি। আগামী ২ নভেম্বর এই আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেরিনা জাহান।

এ বিষয়ে রেজাউর রশীদ খান প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ বলেছে, ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনে তাঁর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর) আসনের উপনির্বাচন ১৪ দলের হয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা ভূপেন্দ্র ভৌমিক। তিনি প্রথমে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন শেষ বেলায় এসে তিনি তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দা জাকিয়া নূর। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শপথ নেওয়ার আগেই মারা যান সৈয়দ আশরাফ।

নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শরিকেরা

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের দুই মাসের মাথায় জাতীয় সংসদে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মানুষ ভোটের অধিকার হারাচ্ছেন বলে বক্তব্য দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে বরিশালের অশ্বিনীকুমার টাউন হলে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখার সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাননি। এর বড় সাক্ষী আমি নিজেই। আজ মানুষ তাঁদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ এই বক্তব্যের পর ১৪ দলের পক্ষ থেকে রাশেদ খান মেননের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পরে তিনি ব্যাখ্যাও দেন।

ওয়ার্কার্স পার্টির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দলের পলিটব্যুরোসহ নানা পর্যায়ে বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ১৪-দলীয় জোটে থাকলেও সরকারের নানা অনিয়ম ও নির্বাচনব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে ভবিষ্যতে তারা সোচ্চার হবে।

১৪ দলের মধ্যে এমন আলোচনা আছে, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিরা সিইসি এবং কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এককভাবে বিষয়টি করতে গেলে সমালোচনা হবে, রাজনৈতিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাই শরিকদের পাশে রেখে কাজটি করা গেলে সেই প্রশ্ন জোরালোভাবে উঠবে না। অন্যদিকে শরিকদের তালিকা থেকে কমিশনের কেউ নিয়োগ পেলে তারাও কিছুটা খুশি হবে।

১৪ দলের শরিক দল শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদের জাতীয় কমিটির সাধারণ সভা হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই সভায় গত সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন নেতারা। গত নির্বাচনের পর দলটি ১৪ দলের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে না।

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে মানুষ হতাশ। তাঁদের দল সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সোচ্চার থাকবে।