করোনাকালেও থেমে নেই আ.লীগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত

এসব সংঘাতের বড় কারণ আধিপত্য বিস্তার, পছন্দমতো কমিটি গঠন, সরকারি উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও বালুমহাল দখল ইত্যাদি।

করোনা মহামারির মধ্যেই গত বছরের আগস্টে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় শুভ শীল (২০) নামের ছাত্রলীগের এক নেতার ডান হাতের কবজি কেটে নেওয়া হয়। কেবল তা-ই নয়, বিচ্ছিন্ন কবজি নিয়ে উল্লাস করেন হামলাকারীরা। এই উপজেলায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘাত অনেক দিন ধরে চলে আসছে। করোনার সময় গত ১৯ মাসে অন্তত পাঁচটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এখানে।

শুভ শীলের সঙ্গে গত বুধবার রাতে ফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, রাজনীতি করার জন্য জীবনের এত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, তা ভাবনায়ও ছিল না। তাঁর জীবন এখন দুর্বিষহ। তিনি বলেন, তাঁকে হামলা করা কয়েকজন কারাগারে আছেন। কয়েকজন অভিযুক্ত জামিনে মুক্ত হয়ে গেছেন।

করোনা মহামারির কারণে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা কম। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের প্রায় ৭০০ নেতা-কর্মী করোনায় মারা গেছেন। এই কঠিন সময়েও ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক সহিংসতা, এর সঙ্গে কারা জড়িত এবং এসব ঘটনায় হতাহতের তথ্য সংরক্ষণ করে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বেসরকারি এই সংস্থা ১০টি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজেদের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

আসকের হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে দেশে রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা ঘটেছে ৪৩৯টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাত ১৫৮টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা ছিল ৮৯টি। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে এমন ঘটনা ৬৯টি। এসব অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২১ জেলায় নিহত হন ৩২ জন। তাঁদের মধ্যে বড় অংশ দলীয় নেতা–কর্মী। এ ছাড়া সরকারি দলের দুই সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষও নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে চারজন, সিরাজগঞ্জে তিনজন এবং যশোর, বগুড়া, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে দুজন করে নিহত হন। এ ছাড়া একজন করে নিহত হন বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, বরগুনা, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, কুষ্টিয়া, পাবনা, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও কুমিল্লা জেলায়।

এই সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও অনেকগুলো সংঘাত হয়েছে। সেসব সংঘাতের বড় অংশ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সূত্র এবং এ-সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ সংঘাতগুলোর বড় কারণগুলো হচ্ছে এলাকায় ও দলে আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, পছন্দমতো কমিটি গঠন, সরকারি উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, বালুমহাল দখল ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বড় দলে বিভক্তি থাকবেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে বহিরাগতও অনেক দলে ঢুকেছে। ফলে আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব হচ্ছে। এ জন্য দলকে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তবে অভিযোগ এলে বা সংঘাত হলে সরকার কোনো ছাড় দিচ্ছে না। দলও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ বিরোধী দল মাঠে খুব একটা নেই। ফলে এ সময়ের মধ্যে যেসব রাজনৈতিক সংঘাত হয়েছে বা হচ্ছে, এর বেশির ভাগই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচনায় আসে নোয়াখালী ও নাটোরের ঘটনাবলি।

নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনের পাঁচবারের সাংসদ অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও দলের সভাপতি হয়েও নিজ জেলা শহরে প্রবেশ করতে পারেন না। যাঁর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, তিনি নাটোর সদর আসনের সাংসদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুল। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন জেলার বাকি সাংসদ ও নেতারাও।

গত ২৭ জুলাই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে আবদুল কুদ্দুস কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর সেই বক্তৃতার ভিডিও পরে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে আবদুল কুদ্দুসকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর সব সময় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে থাকতে নাটোরে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু বাসার মালিককে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে আমাকে বিতাড়িত করতে হুমকি দেওয়া হয়। বাসার মালিক আমাকে বলেন, আমাদের জীবন আগে। তখন আমি বাসা ভাড়ার জামানতের টাকা ফেরত নিই। আমাকে নাটোরে একটি অফিস দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই অফিসে ঢুকতে পারিনি।’ ২৬ মিনিটব্যাপী বক্তব্যে প্রবীণ এই নেতা তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আবদুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁকে কথা বলতে বারণ করেছেন।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় দলের বিভিন্ন কমিটি নিয়ে নেতাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি আছে। নেতায় নেতায় প্রতিযোগিতা হয়। তবে ভুল-বোঝাবুঝি অবসানের চেষ্টা হচ্ছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে দলের সাংসদদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসেন নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। কাদের মির্জা পরবর্তী সময়ে দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী এবং বড় ভাই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও ভাবি ইশরাতুন্নেসা কাদেরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকেন। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর এ পর্যন্ত ১২টির বেশি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষে এক সাংবাদিক ও দলীয় এক নেতা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী। সর্বশেষ গত বুধবার বসুরহাটে জাতীয় পার্টির এক নেতাকে মারধর করে আলোচনায় আসেন মেয়র আবদুল কাদের মির্জা।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এক যুগে আওয়ামী লীগের অনেক অর্জন আছে। তবে দলীয় বিশৃঙ্খলা অর্জন কিছুটা ম্লান করে দেয়। তিনি মনে করেন, নোয়াখালীর সমস্যা সমাধান হওয়ার পথে।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে প্রয়াত সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব একসময় বেশ আলোচিত ছিল। সেটা এখনো মেটেনি। এখন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগেও দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং অন্যটি প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী। এই দুই পক্ষের মধ্যে করোনা মহামারিতে অন্তত চারবার সংঘাত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুবার এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে একবার মারামারি হয়।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতর স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়েছে বলে মনে করেন দলের নেতাদের অনেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, টানা এক যুগ ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হয়নি দলীয় নেতৃত্বকে। এ সময় প্রশাসনই আওয়ামী লীগের হয়ে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করেছে। অন্যদিকে দলের নেতাদের একটা বড় অংশই দরপত্র নিয়ন্ত্রণ বা টেন্ডার-বাণিজ্য, জমি দখল, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত আছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ নিজ দলের নেতা-কর্মীরা। ফলে মার খেয়েছেও আওয়ামী লীগ, দিয়েছেও আওয়ামী লীগ। করোনাকালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।