কেমন ছিল আ.লীগের আগের সম্মেলনগুলো

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন। ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় কর্মী সম্মেলন। এতে তৎ​কালীন মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসারা অংশ নেন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন। ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় কর্মী সম্মেলন। এতে তৎ​কালীন মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসারা অংশ নেন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া


মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরোধিতা করে প্রগতিশীল একটি অংশ দল থেকে বেরিয়ে এসে কর্মী সম্মেলন করল। এ সম্মেলন হলো ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন। পুরান ঢাকার কে এম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনের ওই সম্মেলনেই ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ এখন ৬৭ বছরে পা দিয়েছে। কাল শনিবার থেকে দুই দিনব্যাপী ২০তম সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে দলটি।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বই ও আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, আগের প্রতিটি সম্মেলনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশ বা দলটি নিজেদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কোনো কোনোটি এ দেশের ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দিয়েছে। তবে ক্ষমতায় থাকার চেয়ে বিরোধী দলে থাকার সময়ই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এসেছে নতুন গতিধারা।

১৪ নভেম্বর ১৯৫৩। মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কাউন্সিল। এতে আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৪ নভেম্বর ১৯৫৩। মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কাউন্সিল। এতে আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

রোজ গার্ডেনের ওই কর্মী সম্মেলনের পর ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৫ সালের পরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে। এ কাউন্সিলের বিশেষত্ব হলো এবারই দলকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়।

১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে দলটির পরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে খাজা নাজিমুদ্দিনপন্থী মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সভাপতি পদে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছয় দফা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা অনুমোদন হয়। এ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ।

১৯৫৭ সালের কাউন্সিলে স্বায়ত্বশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৫৭ সালের কাউন্সিলে স্বায়ত্বশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের শেষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৪ জুন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং এর রায় মেনে নিতে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অসম্মতি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই সম্মেলনে সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ৬ দফা ও ১১ দফার বাস্তবায়নের জন্য এ নির্বাচনকে একটি গণভোট হিসেবে গ্রহণ করতে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে ৬ দফা অনুমোদন হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে ৬ দফা অনুমোদন হয়। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। বাংলাদেশে শাসক দল আওয়ামী লীগের এর পরের সম্মেলন হয় ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। এ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয় যে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা দলের পদে থাকতে পারবেন না। ফলে বঙ্গবন্ধু দলীয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের সভাপতি হন এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম কাউন্সিল। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম কাউন্সিল। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া


এরপরই ঘটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হন সপরিবারে। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের ভেতরে নিহত হন আওয়ামী লীগের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুঃসময় এসে হাজির হয়। এই ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলন। সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটির বদলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ৪৪ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়।

১৯৭৪ সালের কাউন্সিলে দলীয় পদ ছাড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৭৪ সালের কাউন্সিলে দলীয় পদ ছাড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া


পরের বছর ১৯৭৮-এর এপ্রিলে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। বঙ্গবন্ধুবিহীন ও চার গুরুত্বপূর্ণ নেতাহীন আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ ও দলকে আরও শক্তিশালী করতে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় ১৯৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সম্মেলনে।

১৯৭৭ সালের কাউন্সিলে জোহরা তাজউদ্দিন আহ্বায়ক হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৭৭ সালের কাউন্সিলে জোহরা তাজউদ্দিন আহ্বায়ক হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

ছয় বছর পর ১৯৮৭ সালের ১ থেকে ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের চতুর্দশ সম্মেলন। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও সাজেদা চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের এই পতনের ফলে বাজার অর্থনীতি নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলায় আওয়ামী লীগ। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারা থেকে বের হয়ে ১৯৯২ সালে দলটির সম্মেলনে নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালার আলোকে দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের সংশোধনী আনা হয় ওই কাউন্সিলে।

১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো সভাপ তি হন। অবশ্য তখনও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো সভাপ তি হন। অবশ্য তখনও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

১৯৭৫-এর বিয়োগান্ত ঘটনার দীর্ঘ সময় পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির সম্মেলন হয় ১৯৯৭ সালের মে মাসে। এরপর ২০০২ সালের সম্মেলনেও শেখ হাসিনা সভাপতি থাকেন। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে জিল্লুর রহমানের জায়গায় আসেন আবদুল জলিল। এক-এগারোর সামরিক সরকারের শাসনের পর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের অষ্টাদশ সম্মেলনে সভাপতির পদে কোনো পরিবর্তন না এলেও সাধারণ সম্পাদক পদে আসেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিন বছর পর ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের উনিশতম সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে কোনো সংশোধন আনা হয়নি। পরিবর্তন হয়নি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদেও।

২০১২ সালে সর্বশেষ কাউন্সিলে সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পুনর্নির্বাচিত হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
২০১২ সালে সর্বশেষ কাউন্সিলে সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পুনর্নির্বাচিত হন। ছবি: আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া