ছাত্রলীগের কমিটি থাকলেও সংঘাত, না থাকলেও সংঘাত

গত এক দশকে দুবার কমিটি হয়েছিল। দুই দফায়ই সংঘর্ষের ঘটনায় কমিটি স্থগিত ও নেতাদের বহিষ্কার করা হয়।

শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে নাহিদ হোসেনকে কোপাতে দেখা যায়। ১৯ এপ্রিল দুপুরে
ছবি: ডেইলি স্টার

কমিটি থাকুক বা না থাকুক, সংঘাত আর নেতিবাচক কার্যক্রমই যেন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রধান কর্মকাণ্ড। এ কলেজে গত এক দশকে দুবার ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমবার সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় কমিটি স্থগিত হয়। দ্বিতীয়বারও সংঘর্ষের ঘটনায় কমিটির আহ্বায়কসহ ১৯ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা কলেজেও ছাত্রলীগের একক আধিপত্য রয়েছে। এই কলেজে এখন ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম নেই। কলেজের ছাত্রাবাসগুলো কার্যত ছাত্রলীগই নিয়ন্ত্রণ করে। ছাত্রাবাসে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন মারামারি-সংঘর্ষে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করেন ছাত্রলীগ নেতারা। কথা না শুনলে সাধারণ ছাত্রদের ‘বিচারের’ মুখোমুখি হতে হয়। এ ছাড়া নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি এবং ওই এলাকার রাস্তায় বিভিন্ন অজুহাতে গাড়ি আটকে রেখে চাঁদাবাজিতেও এখানকার নেতারা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত সপ্তাহে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটসহ আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনার পর এই কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। এ সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সর্বশেষ দুই কমিটিতে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে বহিষ্কৃত নেতাদেরও নানাভাবে সক্রিয় দেখা গেছে। এবারের সংঘর্ষের সূত্রপাত নিউমার্কেটের দুই দোকানের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগ নেতাদের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। পরে সংঘর্ষে কর্মীদের ব্যবহার করেন তাঁরা। অভিযোগ রয়েছে, বিবাদে লিপ্ত দুই কর্মচারীর একজনের সঙ্গে ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্রলীগ নেতার ‘লেনদেনের’ সম্পর্ক ছিল।

‘ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ একটি সেনসিটিভ ইউনিট। সেখানে অনেক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু হিসাব-নিকাশও আছে। ঈদের পর ঢাকার কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পরিকল্পনা আছে। এরপরই ঢাকা কলেজের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
রানা হামিদ, ঢাকা কলেজের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি

সংঘাতে কমিটি স্থগিত-বহিষ্কার

প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে ফুয়াদ হোসেন ওরফে পল্লবকে সভাপতি ও সাকিব হাসান ওরফে সুইমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আসাদুজ্জামান আল ফারুক নামের এক ছাত্র নিহত হন। এর পরদিনই ঢাকা কলেজ শাখার কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সাত নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

এরপর প্রায় তিন বছর ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর নূরে আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজুকে আহ্বায়ক করে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর দুই মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়ার অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষের সময় কলেজের ছাত্রাবাসের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর এবং সাতটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন নেতা–কর্মীরা। ওই ঘটনায় সেদিনই আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়াসহ ঢাকা কলেজ কমিটির ১৯ নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই কমিটি বিলুপ্ত বা স্থগিত না করা হলেও ক্যাম্পাসে ‘বিলুপ্ত কমিটি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

২০১৭ সালের ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের আর কোনো কমিটি হয়নি। নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনা দীর্ঘ হওয়ার পেছনে কমিটি না থাকাকে কারণ হিসেবে দেখছেন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। তাঁদের দাবি, কমিটি থাকলে ছাত্রদের সেদিন নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

ঢাকা কলেজ শাখা কমিটির বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে গতকাল মঙ্গলবার বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁরা ফোন ধরেননি। ঢাকা কলেজের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি রানা হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ একটি সেনসিটিভ ইউনিট। সেখানে অনেক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু হিসাব-নিকাশও আছে। ঈদের পর ঢাকার কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পরিকল্পনা আছে। এরপরই ঢাকা কলেজের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

‘এটা কি শুধু ঢাকা কলেজের সমস্যা? এটা সারা দেশেরই সমস্যা। আমরা ছাত্রদের মোটিভেট করা ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা থাকে। হল সুপাররা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন।’
এ টি এম মইনুল হোসেন, ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

সংঘাত থেমে নেই

কমিটি না হলেও ঢাকা কলেজের সর্বশেষ কমিটির নেতারা পরবর্তী কমিটির শীর্ষ পদপ্রত্যাশী হিসেবে সক্রিয় আছেন। তাঁরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘প্রটোকল’ দেওয়া, অর্থাৎ তাঁদের পেছনে পেছনে থাকা, মোটরসাইকেল বহর নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যাওয়া এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অব্যাহত রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটির বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকার, জসীম উদ্দিন, সুজন সরকারসহ অনেকেই আছেন। সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি সংঘাতের বিভিন্ন ঘটনায়ও তাঁরা নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায়ও এসব নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা সক্রিয় ছিলেন।

ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরাই এখন মূলত ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের নেতৃত্বেই কিছুদিন পরপর সংঘাতে জড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেও তাঁরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। নিউমার্কেট এলাকায় সাম্প্রতিক সংঘাতের দুই সপ্তাহ আগে, গত ৩০ মার্চ রাতে পার্শ্ববর্তী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরা। চায়ের দোকানে বসা নিয়ে কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ওই সংঘাতের সূত্রপাত হয়। ওই সংঘর্ষে দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়াতে দেখা গেছে ঢাকা কলেজের নেতা-কর্মীদের।

ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়ানোর কারণ কী—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ছাত্র, ওই এলাকার ব্যবসায়ী-কর্মচারী ও বাসিন্দাদের বক্তব্যে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। এগুলো হলো আধিপত্য বিস্তার, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ছাত্রাবাসে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ফুটপাতের চাঁদাবাজির ভাগ–বাঁটোয়ারা ও নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পক্ষে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ‘ভাড়ায় খাটা’। সংঘাতের ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির না থাকাটাও একটা কারণ বলে সাধারণ ছাত্ররা মনে করেন।

ছাত্রাবাসের নিয়ন্ত্রণ

ঢাকা কলেজে মোট আটটি ছাত্রাবাস আছে। এর মধ্যে সাতটিই স্নাতক-স্নাতকোত্তরের ছাত্রদের জন্য। এগুলো হলো উত্তর ছাত্রাবাস, দক্ষিণ ছাত্রাবাস, পশ্চিম ছাত্রাবাস, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হল, শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস ও দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস। এ ছাড়া উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রদের জন্য রয়েছে শেখ কামাল ছাত্রাবাস।

ঢাকা কলেজের স্নাতক-স্নাতকোত্তরের একাধিক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের শেখ কামাল ছাত্রাবাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। এই হলে কলেজ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু স্নাতক-স্নাতকোত্তরের জন্য থাকা সাতটি হলে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব হলের কোন কক্ষে কে থাকবে, তা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেতারা। কক্ষ দখল ও ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে প্রায়ই ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তৈরি হয়। ছাত্রাবাসে থাকতে হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক। নেতাদের বা ‘বড় ভাইদের’ নির্দেশে যেতে হয় মারামারি-সংঘর্ষেও। ছাত্রলীগের অবাধ্য হলে সাধারণ ছাত্রদের ‘বিচারের’ মুখোমুখি হতে হয়।

কথিত এই বিচারের জন্য সাতটি হলেই নির্ধারিত কক্ষ আছে বলে জানালেন ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের একজন ছাত্র। তাঁর ভাষ্য, নর্থ হলের ১২০ নম্বর কক্ষে কিছুদিন পরপরই প্রথম বর্ষের ছাত্রদের বিচার বসে। সেখানে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নেওয়াসহ নানা বিষয়ে ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন নেতারা। জবাব পছন্দ না হলে বকাঝকা ও সতর্ক করা হয়। মাঝেমধ্যে ছাত্রাবাসের মাঠেও প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর তাঁদের মধ্যে যাঁরা ছাত্রলীগের কর্মী বা আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তাঁরা নতুন প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ‘বিচার’ করেন। এভাবেই প্রতিটি বর্ষের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করা হয়।

কী বলছে কর্তৃপক্ষ

ঢাকা কলেজের হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে কি না—জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা কি শুধু ঢাকা কলেজের সমস্যা? এটা সারা দেশেরই সমস্যা। আমরা ছাত্রদের মোটিভেট করা ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা থাকে। হল সুপাররা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন।’

ঢাকা কলেজের ছাত্ররা কেন বারবার সংঘাতে জড়ান, এ প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, ‘এটা আসলে বলা মুশকিল। কারণ, এটা মব সাইকোলজির বিষয়। এ ধরনের সমস্যা বিভিন্ন সময়েই হয়ে থাকে। বাইরের বা ভেতরের কেউ এগুলোতে (সংঘাত) ইন্ধন জুগিয়ে থাকতে পারে। এটি আসলে তদন্তের বিষয়। সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠনের চিন্তা করছি।’