নতুন নামে জামায়াত?

.
.

নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। নতুন এই দলের সম্ভাব্য নাম ঠিক করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)। তবে, গোপনে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে। নতুন দলে জামায়াতের ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী নেতাদের ঠাঁই হবে না।
জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, শিগগিরই তাদের দল নিষিদ্ধ হতে পারে ধরে নিয়ে সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারকেরা নতুন দল গঠন করার সিদ্ধান্ত অনেকটাই চূড়ান্ত করেছেন। ইতিমধ্যে বিডিপি নামে নতুন দল গঠনের কথা মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সভায় বলা শুরু করেছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
জামায়াতের সূত্র জানায়, নতুন দল গঠনের পাশাপাশি দলটি পরিচালনার জন্য শীর্ষস্থানীয় সম্ভাব্য দুজন নেতার নামও মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। নতুন দল বিডিপির সভাপতি হতে পারেন জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দলের সাবেক সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদকে ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য পদের নেতাদের দায়িত্ব বণ্টনের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকে মূল দলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শফিকুর রহমান বিডিপির সভাপতি হলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হতে পারেন দলের ঢাকা মহানগর কমিটির আমির রফিকুল ইসলাম খান। তিনি শফিকুর রহমানের প্রায় সমবয়সী। এরপরও তাঁকে কেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল পদে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে দলে বিভিন্ন ধরনের কথা আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের মধ্যম সারির একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আদালত যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, সে আশঙ্কা থেকে নতুন দল করছেন নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু মূল দল জামায়াত বিলুপ্ত করা হচ্ছে না। ফলে নতুন দলে জামায়াতেরই কর্তৃত্ব ও প্রভাব থাকবে। সে চিন্তা থেকে রফিকুল ইসলাম খানকে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হচ্ছে বলে মনে করছেন ওই নেতা।
এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত যে নতুন নাম নিয়ে রাজনীতি করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। মিসরেও এভাবেই তারা ক্ষমতায় গিয়েছিল। তিনি বলেন, সরকারের কাছে তাঁদের দাবি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। যেখানে ধর্মের নামে রাজনীতি করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, জামায়াত নতুন নামে এলেও দেখতে হবে, তাদের রাজনৈতিক দর্শন কী হয়। তারা যদি মওদুদীবাদ ত্যাগ করে এবং বাংলাদেশের সংবিধান মেনে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তিনি আপত্তির কিছু দেখেন না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন সদস্য বলেন, নিষিদ্ধ হলে জামায়াতকে বিলুপ্ত করার চিন্তা না রেখে নতুন নামে দল গঠন নিয়ে বিতর্ক আছে। নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত হবে সুবিধাবাদী। অর্থাৎ, আবার জামায়াত পুনর্গঠন করার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া জামায়াতের ষাটোর্ধ্ব নেতারা নতুন দলের নেতৃত্বে থাকবেন না। তাঁরা মূল দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতেই থেকে যাবেন। তবে তাঁরা প্রকাশ্য রাজনীতি করবেন না। মূলত এসব নেতা গোপনে জামায়াতের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এবং নেপথ্যে থেকে নতুন দলকে পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক এড়াতে বয়সভিত্তিক এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অন্যতম পর্যবেক্ষক ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, জামায়াত সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য তৈরি আছে। তবে তারা মনে করে, কোনো আইনগত ও গণতান্ত্রিক দলকে নিষিদ্ধ করা যায় না। সরকার এ কাজটি করবে না।’
জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, চার দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালায় জামায়াত। এই চার দফা কর্মসূচি হলো ১. দাওয়াত ও তাবলিগ (চিন্তার পরিশুদ্ধি ও পুনর্গঠন), ২. সংগঠন ও প্রশিক্ষণ, ৩. সমাজসংস্কার ও সমাজসেবা, ৪. রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও সংশোধন। কার্যত ৪ নম্বর দফার কর্মসূচিই জামায়াতের রাজনৈতিক রূপ। সামনে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নতুন দল বিডিপি এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
নতুন দল গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের দুজন নেতা বলেন, নিষিদ্ধ হলে সংগঠনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফা অর্থাৎ, দাওয়াত ও তাবলিগ এবং সংগঠন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিয়ে গোপনে কাজ করবেন দলের ষাটোর্ধ্ব নেতারা। আর ৩ নম্বর দফা ‘সমাজসংস্কার ও সমাজসেবা’ কর্মসূচি চলবে সমমনা বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের নামে। এ ছাড়া আলেমদের নিয়ে আলাদা সংগঠন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে একটি টিম গঠন করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা তাঁদের নেই। তবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের আইনের যতটুকু সংশোধন প্রয়োজন সেটা তাঁরা করবেন। এরপর আদালতে বিচারে যা হওয়ার হবে।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।
অবশ্য, ২০১৪ সালের ২২ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান। বর্তমানে কারাবন্দী এই নেতা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘জামায়াত এর আগেও একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এ নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত না। সে প্রস্তুতি আমাদের আছে। নিষিদ্ধ হলে কীভাবে কাজ করতে হয়, সে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’
নতুন নামে যদি জামায়াত রাজনীতি করতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই আইন মেনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, নিবন্ধনের সময় যদি দেখা যায়, এই দলের সঙ্গে একাত্তরের মানবতাবিরোধীরা যুক্ত, তাহলে তারা নিবন্ধন পাবে না। আনিসুল হক জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, তাদের এ দেশে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।