নাটোর বিএনপি এখনো দুলুময়

রুহুল কুদ্দুস তালুকদার

নাটোর বিএনপির সাবেক সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ওরফে দুলুর বাড়ি শহরের আলাইপুর এলাকায়। তাঁর এই বাড়ি জেলা বিএনপিরও কার্যালয়। রাস্তার অপর পাশে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হকের বাড়ি। তিনি এর আগে এক দশক রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, জেলা বিএনপি এখন এই দুই নেতার বাড়ির মধ্যেই বন্দী। সর্বশেষ কবে কোনো খোলা চত্বরে প্যান্ডেল ও মঞ্চ নির্মাণ করে বিএনপি কোনো কর্মসূচি পালন করেছে, তা মনে করতে পারছেন না দলের নেতারাই।

গত ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর দুদিন সন্ধ্যার পর জেলা বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িটি তালাবদ্ধ। নেতা-কর্মীদের আনাগোনা দূরে থাক, বাড়িতে কোনো আলোই জ্বলছে না।

রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ঢাকা, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে এই সরকারের আমলে। ফলে নাটোরে তিনি কম আসেন। স্থানীয় নেতারা বলছেন, মাঝেমধ্যে রুহুল কুদ্দুস এলে বাড়িতে আলো জ্বলে। নেতা-কর্মীদের টুকটাক যাতায়াত বাড়ে। বাকি সময় কার্যালয় তালাবদ্ধই থাকে। দলীয় কার্যক্রম অন্য নেতাদের বসার ঘর কিংবা ফোনে ফোনেই চলে।

২০০৯ সালে নাটোর জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলনে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার সভাপতি ও আমিনুল হক সাধারণ সম্পাদক হন। প্রায় এক দশক পর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর আমিনুল হকের নেতৃত্বে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনসহ পরিবারের ছয়জন সদস্য স্থান পেয়েছেন। এর আগে জেলা সভাপতি থাকা অবস্থাতেই ২০১৬ সালে রুহুল কুদ্দুস বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন। দায়িত্ব পান রাজশাহী বিভাগের।

স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নাটোরের রাজনীতিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল রুহুল কুদ্দুসের। তখন তিনি ছিলেন উপমন্ত্রী। তখন তাঁর কথাই ছিল নাটোর বিএনপিতে শেষ কথা। তাঁর বাসায়ই ছিল দলের ঠিকানা। তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগও। তবে আওয়ামী লীগের টানা এক যুগের শাসনামলে রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের সেই প্রভাব–প্রতিপত্তি আর নেই। বিএনপি এখন আর প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ করতে পারে না। তবে এলাকায় আগের দাপট না থাকলেও নাটোর বিএনপি এখনো রুহুল কুদ্দুস দুলুর কথাতেই চলে। এ বিষয়ে কথা বলার সময় স্থানীয় বিএনপির নেতাদের অনেকেই দলের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, ‘কথা বললেই তা দুলু ও তাঁর পরিবারের বিপক্ষে যাবে। কিন্তু নাটোর বিএনপিতে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলে টিকে থাকার উপায় নেই। এ জন্য সবাই চুপ।’

দলীয় সূত্র জানায়, দুলুর বিপক্ষে কথা বলে ২০১০ সালের দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তৎকালীন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম। তিনি এর আগে ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বাড়িতে একাধিকবার হামলাও হয়েছে। অবশ্য গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শহীদুলকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

গত ২১ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের মতে, দলের নেতৃত্ব যেহেতু রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের কবজায়, তাই তিনি নিষ্ক্রিয় হলে বা অনুপস্থিত থাকলে দলও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

রুহুল কুদ্দুস তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়িতে নিশ্চয় দেখছেন গুলির চিহ্ন, কাচ ভাঙা। যেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আবদুল কুদ্দুস নিজ দলের নেতাদের ভয়ে জেলা সদরে যেতে পারেন না; এই অবস্থায় পুলিশের বাধা, গুলি-বোমার কারণে বিএনপির কার্যক্রম চালানো কঠিন। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি।’

সম্মেলন কবে

বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি দুই বছরের বেশি সময় পার করে ফেলেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু ইউনিয়ন কমিটি করা হয়েছে। তা–ও প্রকাশ্যে কোনো সম্মেলন হয়নি। সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা সম্মেলনের আগে আয়োজন করে উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি গঠন করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেই বিষয়ে সন্দিহান স্থানীয় নেতারা।

বিএনপি সূত্র বলছে, এখন সব স্তরে সম্মেলন করে কমিটি করার মতো সাংগঠনিক অবস্থা নাটোরে নেই। প্রশাসন থেকেও চাপ আসতে পারে। এ জন্য উপজেলা ও পৌরসভায় পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করে জেলা সম্মেলন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা আছে।

স্থানীয় বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, প্রশাসন ও সরকারি দলের চাপ ও দলে অনৈক্য—সব মিলিয়ে খোলা মাঠে আয়োজন করে জেলা সম্মেলনও করা যাবে কি না সংশয় আছে।

অবশ্য আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব রহিম নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ ইউনিয়ন কমিটি হয়ে গেছে। উপজেলা কমিটিতে টুকটাক সমস্যা ছিল। তা–ও সমাধান হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। মাস দুয়েকের মধ্যে জেলা সম্মেলন করে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।

দুলুর পরিবার, নাকি অন্য কেউ

নাটোর বিএনপি কি আবারও রুহুল কুদ্দুস দুলুর পরিবারের হাতেই যাচ্ছে? এই আলোচনাই এখন জেলার অধিকাংশ নেতার।

দলীয় সূত্র জানায়, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সময় একটা নির্দেশনা ছিল, আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব—এসব পদের নেতারা পরবর্তী কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে পারবেন না। তাই আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আহ্বায়ক আমিনুল হক নেতৃত্বের দৌড়ে থাকছেন না বলে মনে করা হচ্ছে। যুগ্ম আহ্বায়ক রহিম নেওয়াজ এবং খবীর উদ্দিন শাহরও সম্ভাবনা থাকছে না।

বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে প্রথম নামটিই রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের। এরপর আছেন সিংড়ার সাবেক সাংসদ এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য গোলাম মোর্শেদ। আছেন জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, দুলুর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ও ভাই রুহুল আমিন তালুকদার। এর মধ্যে গোলাম মোর্শেদ অসুস্থ।

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপিতে এক ব্যক্তির একাধিক পদ আঁকড়ে থাকার নজির অনেক। ফলে দুলুর জেলার নেতৃত্বে ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। আর তিনি নিজে না থাকলেও ভাই ও স্ত্রীর কাউকে দিয়ে জেলার নেতৃত্ব নিজ হাতে রাখতে চাইবেন বলে এলাকায় আলোচনা আছে।

মামলার কারণে দুলু ২০০৮ ও ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এই দুবারই বিএনপির মনোনয়ন পান তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন।

রুহুল কুদ্দুস তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আর জেলায় ফিরে আসতে চান না। তরুণ কেউ নেতৃত্ব দিক, সেটাই চান। পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘নাটোরের মানুষ আমাদের ভালোবাসে। কাউন্সিলে নেতা-কর্মীরা চাইলে তাঁর পরিবারের কেউ নেতৃত্বে আসতেই পারেন।’

বিএনপি সূত্র বলছে, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এ জন্য প্রশাসন ও সরকারি দল তাঁকে মাঠে নামতে দিতে চায় না। আবার দলে তাঁর প্রভাবের কারণে নাটোরে রুহুল কুদ্দুস ও তাঁর পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। এ জন্য তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের কার্যক্রমও স্থবির থাকে।