নারায়ণগঞ্জে দলের চেয়ে আইভীর ইমেজই বড় শক্তি ছিল: সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। স্থানীয় সরকার নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা দেশ-বিদেশে সমাদৃত। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং এ নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক নানা নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে উচ্চ কণ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের পর একে ‘সর্বোত্তম’ বলেছেন? আপনি এ নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মন্তব্য নির্বাচনের সার্থকতা ও গুণগত মানের সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে বলে আমার মনে হয়েছে। ‘সর্বোত্তম’ শব্দটি সাম্প্রতিক কালে কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেননি, বরং তাঁর মন্তব্যে হতাশার কথা শোনা গেছে বা আভাস পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। দেড় দশক ধরে নির্বাচনের আবহাওয়া বড্ড অস্থির। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ সাংঘর্ষিকও ছিল। এ নিয়ে বোধকরি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। মানুষের কাছে নির্বাচন প্রায় একটা ‘উৎসাহহীন’ ‘পূর্বনির্ধারিত’ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বলে মনে হয়েছে। পত্র-পত্রিকার বিশ্লেষণে এবং কিছু বিশ্লেষকের বিবেচনায় তা-ই প্রতীয়মান হয়েছে। সার্বিকভাবে নারায়ণগঞ্জের এই নির্বাচন একধরনের ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছে, কিন্তু একে নির্বাচনব্যবস্থার উন্নয়ন বললে হয়তো অতি আশাবাদী বিশ্লেষণ হবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সে বিবেচনায় কিছুটা ব্যতিক্রম। একটি নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে ধরে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক কার্যকারিতা নিয়ে যদি উপসংহারে আসা হয়, তা যৌক্তিক হবে না। তবে সার্বিকভাবে আমার মনে হয়েছে, ‘গ্রহণযোগ্য’ এবং ‘জনবান্ধব’ নেতৃত্বের জন্য এটি একটি শুভ বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু এটিও বিবেচনায় নিতে হবে, জয়ী প্রার্থী বা অন্য কেউ হলে ফলাফল ভিন্ন হলেও হতে পারত। সরল সমীকরণে বলা যায়, প্রার্থী ছিলেন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ইমেজ এবং অতীত কার্যক্রম এতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেছেন, ইভিএম জালিয়াতি করে তাঁকে হারানো হয়েছে। এ অভিযোগ কতটুকু যৌক্তিক?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: তৈমুর আলম খন্দকারের অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠ উত্তর দেওয়া এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কতটি কেন্দ্রে কী কারণে ‘ইভিএম জালিয়াতি’ হয়েছে, তেমন কোনো বিস্তারিত তথ্য কিন্তু আমরা লক্ষ করিনি। তাই অভিযোগটি নির্বাচন কমিশনের বিশ্লেষণ ও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আমরা আশা করব, এই অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ জনগণকে জানানো হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিএনপি এই নির্বাচনে থেকেও থাকল না। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীরা দলের নির্দেশ অমান্য করে লড়ছেন এবং বিজয়ীও হচ্ছেন। কিন্তু ইউপিতে শাসকদলের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে শাসকদলের অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু তার প্রকাশ ঘটল না। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে বিএনপির অবস্থানকে কীভাবে দেখেন আপনি, দলটির জন্য সুবিধা এল কিছু?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে উদ্বেগজনক দিক লক্ষ করা গেছে তা হলো, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোর চোখে পড়ার মতো অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা সংঘাতেও রূপ নিয়েছে, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন দৃশ্যমান উপসর্গ। এটি ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে দেখা যাবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রবণতা রাজনৈতিক দলগুলোর ইমেজ, দলীয় শক্তি আর সার্বিকভাবে জন-আস্থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নারায়ণগঞ্জে এটি থাকলেও, দৃশ্যমান হয়নি। যদিও প্রকাশ্যে একে অপরকে কৌশলে-ইঙ্গিতে সমালোচনা করেছেন। তবে এই দ্বন্দ্বের সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত রেষারেষি দলীয় গণতন্ত্র, পাবলিক ইমেজ এবং সার্বিকভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর সুদূরপ্রসারী বিবেচনায়, জনপ্রতিনিধিদের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

এ ক্ষেত্রে বিএনপির সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল বলে মনে হয় না। তারা নির্বাচন বর্জন করেছে, কিন্তু আড়ালে মৌন সমর্থন তো ছিল বলেই মনে হয়। এখানে সুবিধা-অসুবিধা তেমন কোনো কিছু আমি আপাতত দেখছি না। অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক অবস্থান না থাকলে বিরোধী দল বিএনপিকে সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে অনুমান করা যায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন শাসকদল আওয়ামী লীগকে কি কোনোভাবে লাভবান করবে?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: আমি কোনো লাভ-ক্ষতির খতিয়ান এই নির্বাচনে দেখছি না। আমার বিবেচনায়, জয়ী প্রার্থী তাঁর নিজ নাম, ইমেজ, অতীত ঐতিহ্য, কর্মকাণ্ডে দক্ষতা, স্পষ্টবাদিতা, সৎ সাহস এবং সততার কার্ডটি ব্যবহার করেছেন। তার যথার্থ সুফল তিনি পেয়েছেন। এটি আওয়ামী লীগের বিশাল অর্জন, তা বলা হয়তো খুব সংগত হবে না; বরং বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এতে প্রার্থীর ইমেজ একটা বড় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন হলো। কিন্তু একে ঘিরে জাতীয় পর্যায়ে একটা আগ্রহ ছিল। হতে পারে সেটা প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বা শামীম ওসমানের দ্বন্দ্বের কারণে আকর্ষণ। তবু আগামী জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের প্রভাব কতটুকু?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের বেলায় ইস্যুও ভিন্ন ধরনের। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচনের খুব বেশি প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে বলে বলা কঠিন এবং কিছুটা অনুমান-নির্ভর।

জাতীয় সরকারের নির্বাচনের গুণমান নির্ভর করে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সবার জন্য সমান সুযোগ) সৃষ্টি হলো কি না, তার ওপর। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে নানা জায়গা থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মানবাধিকার, রাজনৈতিক সুযোগ ও অংশগ্রহণমূলক আস্থাভাজন পরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছে। এমনকি ‘নিষেধাজ্ঞা’র মতো কঠিন চাপও সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো তা আরও স্পষ্ট হবে। নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা, প্রশাসন, পুলিশ এবং সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।