নির্বাচনকালীন সরকারেই বেশি মনোযোগ তাদের

৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৫টি দল অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেয়নি।

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনপ্রক্রিয়া দ্রুত এগোচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এখন কী হবে, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ এ ধরনের দলগুলো বলছে, ইসি নয়, তাদের লক্ষ্য নির্বাচনকালীন সরকার।

ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টির দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৫টি দল নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাব করেনি। এর মধ্যে বেশির ভাগই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে বিএনপিসহ কয়েকটি দল সংলাপ ও অনুসন্ধান কমিটির ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়েছে দলীয় সিদ্ধান্তে ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। কিছু দল রাষ্ট্রপতির সংলাপে গিয়েও নাম দেয়নি। ধর্মভিত্তিক চারটি দল বলছে, তারা নামের প্রস্তাব দেয়নি সময়ের অভাবে।

সংলাপ ও অনুসন্ধান কমিটিকে এড়িয়ে চলা দলগুলো মনে করছে, নতুন ইসি সরকারের পছন্দের বাইরে যাবে না। আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নতুন ইসিও যে বিদায়ী নূরুল হুদা কমিশনের মতোই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভূমিকা রাখবে, সে বিষয়েও তারা নিশ্চিত। তাই ইসি নিয়ে মাতামাতি না করে তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে মনোযোগী।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনমত উপেক্ষা করে নতুন ইসির গঠন ক্ষমতাসীনদের আরেকটি ভোট চুরির প্রজেক্ট। এখন আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে যাব। যদিও করোনার কারণে এই মুহূর্তে কর্মসূচি স্থগিত আছে।’

বিএনপি ছাড়া অন্য যেসব দল অনুসন্ধান কমিটিতে নতুন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাব করেনি সেগুলো হলো, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাপ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিস।

এর মধ্যে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, অনুসন্ধান কমিটি করুক আর যা–ই করুক, কারা নির্বাচন কমিশনার হবেন, তা সরকারপ্রধানই ঠিক করবেন। এ কারণে তাঁরা সংলাপে ও অনুসন্ধান কমিটিতে অংশ নেননি বলে জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে বহুমুখী সমস্যা চলছে। আমরা বর্তমান দুঃশাসন এবং এর বিকল্প গড়ে তোলার লড়াই চালিয়ে যাব।’

ইসির বিষয়ে কট্টর অবস্থান নেওয়া দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, ১৫টি রাজনৈতিক দল অনুসন্ধান কমিটিতে প্রস্তাব জমা না দেওয়ায় সরকার কিছুটা হলেও চাপে ও বিতর্কে পড়েছে। এটি আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকারের জন্য একটি বার্তাও।

এই বিষয়ে বিজেপির সভাপতি আন্দালিভ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইসি গঠন হয়ে গেলেই যে সবকিছু হয়ে যাবে, তা নয়। আরও দুই বছর সময় আছে।

সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসির গঠনপ্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকার পর এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে, নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার। এ লক্ষ্য সামনে রেখে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে বিরোধী দলগুলোর ভেতরে। এই ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এটুকু বলতে পারি, শিগগিরই একটি বৃহত্তর ঐক্য হবে। আমাদের লক্ষ্য, এ সরকারকে বিদায় করতে হবে। জাতীয় সরকার করতে হবে।’

তবে নতুন ইসির ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকলেও কোনো কোনো দল এ বিষয়ে দৃষ্টি রাখছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত বিতর্কই থাকুক, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে—এটাই বাস্তবতা। এখন অনেকে দেখবে, এত বিতর্কের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন কমিশন আসবে, তারা কী আচরণ করে।’

সংলাপ ও অনুসন্ধান কমিটিতে নাম না দেওয়া কোনো কোনো দলের নেতাদের বিশ্বাস, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু পাল্টে যাবে। এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ মনে করেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক যত অন্যায়-বেআইনি কাজ আছে, সবই বাতিল হয়ে যাবে।’

ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দল অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাব করেনি। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নাম না দেওয়া ছিল নীতিগত অবস্থান। বাকি চারটি দলের মধ্যে নিবন্ধিত দল খেলাফত মজলিশ কোনো চিঠি পায়নি বলে জানান দলটির মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন শেষ সময়ে চিঠি পাওয়ায় নাম দিতে পারেনি বলে দলীয় সূত্র জানায়। বৃহস্পতিবার রাতে দলগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়।

এর মধ্যে প্রয়াত হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ব্যস্ত ছিল কামরাঙ্গীরচর জামেয়া নূরীয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল নিয়ে। হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে দলটির আমির আর নাতি মহাসচিব। দুজনেই জামেয়া নূরীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। ফলে আলোচনা করে যে নাম ঠিক করা হবে, সেই সময় পাওয়া যায়নি বলে জানান খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন।

নাম দিতে না পেরে অনুসন্ধান কমিটিকে চিঠি দিয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবেদীন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চিঠিতে বলেছি, এত অল্প সময়ের মধ্যে ১০ জনের নাম ঠিক করে তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত লিখে পাঠানো সম্ভব নয়।’ জমিয়ত ও খেলাফত আন্দোলন রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়েছিল।

চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যারা কমিটিতে নাম দিয়েছে, তারা হয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে অথবা তাদের পক্ষে বা ছত্রচ্ছায়ায় আছে।

ইসলামী আন্দোলন সংলাপে যায়নি, কমিটিতেও নাম দেয়নি। এখন কী করবে—জানতে চাইলে গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘অন্য দলগুলো কী করে, সেটি আমরা দেখব। প্রয়োজনে অন্য দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হবে। আমরা মনে করি, মূল ফ্যাক্টর হলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। এর জন্য আমাদের যতটুকু শক্তি-সাধ্য আছে, তা নিয়ে আমরা ভূমিকা রাখার চেষ্টা করব।’