পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করে বিশ্বব্যাংক নিজেই বঞ্চিত হয়েছে: মসিউর রহমান

মসিউর রহমান

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ না দিয়ে বিশ্বব্যাংক নিজেকেই বঞ্চিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশে, বহু সময় অবকাঠামোগত প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো জটিল নদী ব্যবস্থায় প্রকল্প আগামী এক-দেড় শ বছরেও হবে না। বিশ্বব্যাংক এ রকম একটি বড় ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রকল্প থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছে, আমরা বঞ্চিত হইনি।’  

আজ শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সেমিনারে মসিউর রহমান এ মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটি আয়োজিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

‘শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নির্মাণ: বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক যুগান্তকারী বিজয়’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় এই সেমিনার।

মসিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, দুর্নীতির অনুমাননির্ভর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। তবে এ সরে যাওয়ায় বাংলাদেশের লাভ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। বলেন, ‘আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার, রাষ্ট্র ও জনগণের ভেতর যে আত্মিক সম্পর্ক সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি টাকাপয়সার হিসাবের চেয়ে অনেক বড়।’

প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়াকে হঠকারী সিদ্ধান্ত ও যে মতবাদের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটির ওপর আঘাত বলে মন্তব্য করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের এই হঠকারিতা মাল্টিল্যাটারালিজম (বহুপাক্ষিকতা) ধারণার ওপরও আস্থার সংকট তৈরি করে। এর যে মূল ‘থিম’ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা—পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ না দেওয়া সেই ধারণাকে আঘাত করে।

পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের বিজয় ও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, ‘পদ্মা আমাদের কাছে ইট-পাথরে নির্মিত একটি সেতু নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো–কোটি বাঙালির আবেগ, আমাদের ভালোবাসা, গৌরব। আজ আমরা আমাদের সক্ষমতাকে উদ্‌যাপন করছি। পদ্মা সেতু আমাদের বিজয়ের প্রতীক; উন্নয়ন, ঘুরে দাঁড়ানো ও হার না মানার প্রতীক।’

গত ১০ বছরের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতুর প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন শিরীন শারমিন চৌধুরী।

সেমিনারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হয় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। মূল্যস্ফীতি ও নির্মাণকাজের সময় অতিরিক্ত কাজ যুক্ত হওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে ওই সময়ে প্রকল্পের যে ব্যয় ধরা হয়েছিল সেই টাকাতেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যয় হয়নি। এ প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া রাজনৈতিক ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এই সেতুর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা না থাকলে এই প্রকল্প হতো না উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিস্তৃত হলো। এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, শুধু নির্মাণশৈলী ও প্রকৌশলগত দিক থেকেই পদ্মা সেতু অনন্য নয়, পদ্মা নদীর যে ভয়াবহতা, তা বিশ্বের খুব কম নদীর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। এই সেতু বাঙালি জাতির সম্মান ও মর্যাদা বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছে।

সেমিনারে পদ্মা সেতু নির্মাণের কারিগরি দিক নিয়ে বক্তব্য দেন পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দুই নদ–নদীর মিলিত শক্তি হচ্ছে পদ্মার। প্রতি সেকেন্ডে এই নদীর পানি ১৫ ফুট পর্যন্ত এগিয়ে যায়।

প্রমত্ত এই নদীতে সেতু নির্মাণের নানা জটিল দিক উল্লেখ করে আইনুন নিশাত বলেন, এই সেতু থেকে অর্থনৈতিক সুফল আরও বাড়াতে হলে সেতু নির্মাণের সময়ই বরিশালে যাওয়ার সড়ক প্রশস্ত করা উচিত ছিল। সেতুর আরও সুফল পেতে সঠিক জায়গায় মোংলা বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এটি ভুল জায়গায় করা হয়েছে। পদ্মা সেতু পার হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু পার হতে গিয়ে খুবই এক্সসাইটেড ছিলাম; চোখে পানি এসে গিয়েছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শবনম আজিমের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।