পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, প্রতিরোধের চেষ্টায়ও বাধা দেওয়ার অভিযোগ

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, পুলিশ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ শুরু করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। উভয় পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে হামলা প্রতিরোধের চেষ্টার সময় বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। এদিকে ওই হামলার ঘটনায় পুলিশের করা দুই মামলায়ই উল্লেখ করা হয়েছে, ২ হাজার ২০০ জনের মতো লোক প্রথমে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া পূজামণ্ডপে হামলা চালায়। পরে তারা হাজীগঞ্জ থানা ও উপজেলা সদরের আরও পাঁচটি পূজামণ্ডপে হামলা করে। হামলায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্র বলেছে, হাজীগঞ্জ আওয়ামী লীগে প্রায় আট বছর ধরেই দুটি বিবদমান পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষ চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি) আসনের সাংসদ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের অনুসারী। অপর পক্ষটির নেতৃত্ব দেন হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন এবং হাজীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহবুব উল আলম। সাংসদ রফিকুল ইসলাম দ্বন্দ্ব মেটাতে ২০১৯ সালে হাজীগঞ্জ উপজেলা উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। সেখানে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন চাঁদপুর আওয়ামী লীগের নেতা মো. আহসান হাবিব এবং হাজীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন।

পূজামণ্ডপ কমিটি সূত্র বলেছে, কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ঘটনা ঘটে ১৩ অক্টোবর। ওই দিন রাত ৮টা ১০ মিনিটে হাজীগঞ্জে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া পূজামণ্ডপে হামলা শুরু হয়। এর ঘণ্টাখানেক আগেই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মণ্ডপটি পরিদর্শন করেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ও পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ। পূজা উদ্‌যাপন কমিটির কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেছেন, কমিটির পক্ষ থেকে হামলার আশঙ্কার কথা জানানো হলে পুলিশ সুপার তাৎক্ষণিকভাবে তিন পুলিশ সদস্যকে ওই মন্দিরে রেখে যান।

পূজা উদ্‌যাপন কমিটির কয়েকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, হামলাকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করতে পারেননি তাঁরা। হামলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মন্দিরের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। সেখানে আগে থেকে তিনজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। হামলার খবর পেয়ে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদসহ ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য সেখানে দ্রুত পৌঁছান। তাঁরাই মূলত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রাত ৯টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা–কর্মী সেখানে যান। হাজীগঞ্জে ওই দিনের সহিংসতায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঘটনার দিনই মারা যান তিনজন।

অবশ্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর রাত ১০টার দিকে হামলাকারীরা পিছু হটে।

হাজীগঞ্জের পৌর মেয়র মাহবুব উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হামলার খবর শুনে তিনি রাত সোয়া ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তারপর আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা–কর্মী সেখানে পৌঁছান। এরপর তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এদিকে হাজীগঞ্জ উপজেলা উন্নয়ন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন, হাজীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন ও তাঁর অনুসারীরা বিভিন্ন স্থানে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে আসা দলের নেতা–কর্মীদের বাধা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, সাংসদের নির্দেশে তাঁরা ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারীদের বাধা দিয়েছেন।

তবে গাজী মাঈনুদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কারা হামলার সময় প্রতিরোধে নেমেছে, আর কারা হামলার সময় নিশ্চুপ থেকেছে, তা ভিডিও ফুটেজে রয়েছে। যারা হামলা করতে এসেছিল, আমরা তাদেরকে বাধা দিয়েছি। আমাদের প্রতিটা নেতা–কর্মী এখন হাজীগঞ্জের হিন্দু বাড়ি ও পূজামণ্ডপ এবং মন্দিরগুলোয় পাহারা দিচ্ছে।’

অবশ্য হাজীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি দিলীপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এমন কোনো পাহারা তাঁরা দেখতে পাননি। হামলার পর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ঘটনাস্থলে হাজির হন।

দলীয় সূত্র বলেছে, হামলার দিন সাংসদসহ স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা এলাকায় ছিলেন না। যা করার প্রাথমিকভাবে স্থানীয় অন্য নেতারাই করেছেন। যদিও তাঁরা পৌঁছেছেন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর। হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল মিয়াজী, হাজীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিনসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা ঢাকায় থাকেন। ঘটনার দিনও তাঁরা ঢাকায়ই ছিলেন। গতকাল শুক্রবার সাংসদ রফিকুল ইসলাম এলাকায় যাওয়ার পর ওই নেতারাও এলাকায় হাজির হন।

এ ব্যাপারে সাংসদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এলাকায় যেতে পারেননি। তবে ঘটনার আধা ঘণ্টা আগেই তিনি পরিস্থিতি আঁচ করে স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করেছেন। দলীয় নেতা–কর্মীদের হামলা প্রতিরোধে অংশ নিতে টেলিফোনে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার চেষ্টায় আরও বড় ধরনের হামলা ঠেকিয়ে আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছি।’

আর হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল মিয়াজী বলেন, ‘আমি ঢাকায় ছিলাম। পরদিন সকালে আমি বিষয়টি জানতে পারি। তারপর ছুটে এসে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ঘুরে দেখে তাদের সঙ্গে কথা বলে হামলার বিষয়টি অবগত হই।’

১২৬ বছরের পুরোনো লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও পৌরসভার প্যানেল মেয়র জায়দুল আজহার আলম। হামলার সময় কী করছিলেন জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি বাজারে আমার দাদার মিলাদ অনুষ্ঠানের কেনাকাটা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি গোলাগুলি চলছে। তখন আমি গোলাগুলি দেখে বাড়ি চলে যাই।’

এদিকে চাঁদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) সোহেল মাহমুদ বলেন, মন্দির–মণ্ডপে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মন্দির কর্তৃপক্ষ করেছে আটটি মামলা। পুলিশ করেছে দুটি মামলা। ভিডিও ফুটেজ দেখে ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে নিশ্চিত হয়ে এ পর্যন্ত ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।