বিএনপির জোট ছাড়ার পর ভাঙল ইসলামী ঐক্যজোটও

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছাড়ল ইসলামী ঐক্যজোট। দলের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী ঘোষণা দেন, ‘২০ দলের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। একই সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোট আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রতিটি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা করছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা দুইটায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আবদুল লতিফ নেজামী জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার দুই ঘণ্টার মাথায় দলের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে জোটে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন, সেপ্টেম্বরে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ও বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি বিএনপির জোট ছেড়েছিল। তারও আগে জোট ছাড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ)। তখনো চারটি দলের কিছু নেতা একই নামে আলাদা দল গঠন করে বিএনপির জোটে থেকে যান।
ইসলামী ঐক্যজোটের এই অংশটি সম্পর্কে দলের যুগ্ম মহাসচিব আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, দু-একজন চলে গেলে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। যাঁরা গেছেন, তাঁরা অস্তিত্বহীন।
গতকাল ইসলামী ঐক্যজোটের সম্মেলনে আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধতার অনিবার্যতা দিন দিন ব্যাপক ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় ইসলামী ঐক্যজোট স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেদের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোযোগী হবে।
পরে জোট ছাড়ার কারণ সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে লতিফ নেজামী বলেন, ‘ঐক্যজোটের কাজে অধিকতর সময় দেওয়ার জন্য আমরা জোট ত্যাগ করেছি। আপনারা দেখেছেন, জোটের কয়েকটা মিটিংয়ে আমরা যাইতে পারি নাই। আমাদের ব্যস্ততার জন্য সময় দিতে পারছি না।’ জোট ছাড়তে কারও চাপ বা ক্ষোভ আছে কি না, জানতে চাইলে নেজামী বলেন, ‘না, না। কোনো চাপও নেই, ক্ষোভও নেই, কিচ্ছু নাই।’ আর মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আমিনী বলেন, সব ইসলামি দলকে নিয়ে তাঁরা একটা ফোরাম করবেন। সে ফোরামের মাধ্যমেই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনী। গতকালের সম্মেলনে আবদুল লতিফ নেজামী দলের চেয়ারম্যান ও মুফতি ফয়জুল্লাহ দ্বিতীয়বারের মতো মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও দলটি চলছে আমিনীর পরিবারের প্রভাবে। নবনির্বাচিত কমিটিতে আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীসহ দুই মেয়ের জামাই ভাইস চেয়ারম্যান। আর এক মেয়ের জামাই সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন।
সম্মেলনে সারা দেশের প্রতিনিধিসহ প্রায় ৫০ জন নেতা বক্তব্য দেন। বক্তাদের প্রায় সবাই সরকার ও আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচনা করে বক্তব্য দিলেও ব্যতিক্রম ছিলেন মুফতি আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত ও মেয়ের জামাই জসিম উদ্দিন। তাঁরা বিএনপিকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেন।
আবুল হাসানাত বলেন, ‘ইসলামের স্বার্থে জোট করেছি, প্রয়োজনে ইসলামের স্বার্থে জোট ভেঙেও দেব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়জন শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ২০০১ সালে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। শহীদের খবর নেননি। এখন আলেমরা বোঝা। বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছিল, না এক লাখ শহীদ হয়েছিল, এগুলো আমাদের জানার দরকার নেই। ইসলামকে এগিয়ে নিতে হবে।’
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বিএনপি হইল পরের কাঁঠাল, পরের মাথা। পরের মাথায় পরের কাঁঠাল ভেঙে খেতে কত স্বাদ। ২০০১ সালে মুফতি আমিনীর আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় গিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আমরা কী দেখতে পেলাম? শায়খুল হাদীস ও মুফতি আমিনী—দুজনকে ভিন্ন করেছে। তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রচারের কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না।’
বিষয়টি নিয়ে বিএনপি কতটা উদ্বিগ্ন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এটাকে তাঁরা খুব বড় ধাক্কা মনে করছেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বিশেষ করে যখন বিরোধী দলে থাকে ছোট দলগুলো। তাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দেয়। তিনি বলেন, জোটের প্রধান শক্তি বিএনপি। সে জন্য এটি রাজনৈতিকভাবে খুব বড় একটা ধাক্কা হবে না। এটি মূলত বিরোধী দল ভেঙে দেওয়ার সরকারি কার্যক্রমের অংশ। জোটের শরিকদের সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছিল।
জোটে থাকার ঘোষণা একাংশের: বিকেল চারটায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে ইসলামী ঐক্যজোটের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর রকিব, আবদুল করিমসহ একটি অংশ। সেখানে আবদুর রকিব ঘোষণা দেন, ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোটে ছিল, থাকবে।
জোট ত্যাগী কমিটিতে আবদুর রকিব দুই নম্বর উপদেষ্টা ও আবদুল করিমের নাম ভাইস চেয়ারম্যান পদে আছে। সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রকিব নিজেকে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও আবদুল করিমকে নতুন মহাসচিব হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ঐক্যজোটের গঠনতন্ত্রে বহিষ্কারের সুযোগ নেই। দলের শৃঙ্খলাভঙ্গ করায় তাঁদের পদ চলে গেছে। ফলে তিনি জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন।
আবদুর রকিব দাবি করেন, ‘সম্প্রতি ইসলামী ঐক্যজোটের কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জোটের আদর্শ ও নীতি-পরিপন্থী পদক্ষেপ নেওয়ায় এর মূল অঙ্গসংগঠন নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়। গতকাল (বুধবার) বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ওই সভায় আবদুল লতিফ নেজামীর পরিচালনায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়, আমরা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলে থাকব। ওই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেই লতিফ নেজামী জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।’
প্রসঙ্গত, ইসলামী ঐক্যজোটে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম ও খেলাফত ইসলামী নামে দুটি দল রয়েছে। আবদুর রকিব নেজামে ইসলামের সভাপতি। এ দলের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী।
রকিব বলেন, ‘তিনি (নেজামী) একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁর পেছনে একটা মহাশক্তি কাজ করতে পারে।’ এই মহাশক্তি কী, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি বলব কেন? আপনারা সাংবাদিক, আমার চেয়ে আপনাদের বেশি অভিজ্ঞতা।’