বৈঠকের পরই জানা যাবে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির খবর
ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। এরপর বিভিন্ন গুজব, আলাপ-আলোচনা হলেও নতুন কমিটি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। কমিটি দিতে আজ বুধবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের মূল দুটি পদপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বসেছেন। এরপর কমিটি ঘোষণায় অগ্রগতি হতে পারে।
সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ। দল মনে করে, জাতীয় নির্বাচনে ছাত্রলীগের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে। এ কারণে নেতৃত্ব নির্বাচনে কোনো ধরনের ‘সিন্ডিকেট’, কৃত্রিম প্রভাব কিংবা কোনো স্বজনপ্রীতি দেখতে চান না আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। যে কারণে এবার তিনি নিজে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন। ফলে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে কারা আসবেন, এ বিষয়ে গুজব ছাড়া ঠিক কারও নাম এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।
ছাত্রনেতাদের ডাকা হয়েছে কেন?
এবার ছাত্রলীগের দুটি মূল পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিপরীতে ৩২৩ জন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে মোট ১৬৯ জন ফরম সংগ্রহ করেছেন। অনেকে দুটি পদের বিপরীতে ফরম সংগ্রহ করেছেন। দুটি পদের বিপরীতে পদপ্রত্যাশী এসব নেতা-কর্মীর বেশির ভাগ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে বসেছেন দলের সভানেত্রী। এ ছাড়া এবার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বয়স ২৮ বছর। গত ২৮তম কাউন্সিলে এই বয়স ছিল ২৯ বছর। বয়সসীমার কারণেও অনেক নেতা বাদ পড়বেন। আর এবার ছাত্রলীগে নেতৃত্ব নির্বাচিত হচ্ছেন ‘সিলেকশন’-এর মাধ্যমে, ফলে সবার মধ্যেই একধরনের ‘আশা’ কাজ করছে। কেউ যেন নিরাশ না হন, সে কারণে আজ বৈঠক করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, আজকের বৈঠকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রধানত একটি বার্তা দেওয়া হবে। সেটি হলো যে-ই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসুন না কেন, সবাইকে এক হয়ে দলের জন্য কাজ করতে হবে। পদ না পেয়ে হতাশ হওয়া কিংবা নতুন কমিটিকে অসহযোগিতার কোনো ঘটনা যেন না ঘটে—এ বিষয়টি ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের বলবেন দলের সভানেত্রী। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ছাত্রলীগের ইতিবাচক ভূমিকাও দেখতে চাওয়া হবে।
জানা গেছে, ছাত্রলীগে কারা নেতৃত্বে আসবেন, বিষয়টি অনেক আগেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্ধারণ করে রেখেছেন। কিছু আনুষ্ঠানিকতা এবং নতুন নেতা নির্বাচনে যাচাই-বাছাইয়ের কারণে এখনো কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে না। তবে আজকের বৈঠকের পর শিগগিরই আংশিক কমিটি ঘোষণা হতে পারে।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন কেন?
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে ‘সিন্ডিকেটের’ কথা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। এর আগে ছাত্রলীগের এই কথিত সিন্ডিকেট কোনো না কোনোভাবে ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছেন। এতে ছাত্রলীগে মনে রাখার মতো কোনো নেতা তৈরি হননি। ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর সেই নেতা সামনে দলের অন্য কোনো ভালো অবস্থানে গেছেন, দু-একটি ছাড়া এমন কোনো দৃষ্টান্ত গত ১০ বছরে ঘটেনি। অথচ ছাত্রলীগ থেকে নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার কথা। এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নেওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হয়নি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগের দুর্বল নেতৃত্ব এবং নিজেদের ‘উন্নয়নে’ সব সময় মনোযোগী হওয়া—এসব বিষয় দায়ী। প্রত্যেক ছাত্রনেতা কোনো না কোনো কেন্দ্রীয় নেতার ‘ম্যান’ হয়ে কাজ করেন। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে থেকে দলের জন্য কাজ করার মতো নেতা গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক চর্চাটাও গড়ে ওঠেনি।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগের ইতিহাসে পদে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের কোনো নেতাকে দলের কর্মীরা ‘ধাওয়া’ দেওয়ার কথা কখনো ভাবতেও পারেনি। কিন্তু সদ্য সাবেক কমিটির ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতে এই আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রলীগ নেতাদের ‘ইন্ধন’ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ইন্ধনের পেছনে মূল কারণ ছিল, শিক্ষাঙ্গন অশান্ত হয়ে গেছে এই মুহূর্তে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব আনাটা ঠিক হবে না—এমন একটি বিষয় সামনে আনার চেষ্টা হয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জানতে পেরেছে। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাসেরও কম সময় হাতে থাকার পরও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
নতুন কমিটির বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি এবার দেখছেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে ঠিক বলা যাচ্ছে না কারা নেতৃত্বে আসবেন। তবে শিগগিরই কমিটি ঘোষণা হবে।
ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা বলছেন, সদ্য সাবেক কমিটির বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। নেতা নির্বাচিত হওয়ার দিনও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থেকেছেন। দলের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ হলের বাইরে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও ততটা ভালো অবস্থানে ছিলেন না। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ ছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় নেতা-কর্মীরা দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন। এসব প্রশ্নের বেশির ভাগই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন নির্মাণকাজের ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ। সেই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারার অভিযোগ। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবনের উৎস এবং দলের নেতা-কর্মীদের কথা না শোনার ব্যাখ্যা—সেদিন এসব জানতে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অনেক নেতা। এর আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সম্মেলন দিতে না দিতেই লন্ডনে গিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করেছেন। যদিও তিনি বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। এসব বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ভাবছে, যার কারণে নেতৃত্ব নির্বাচনে এবার এত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে?
প্রায় ১০ বছর হলো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগকে ঠিক সেভাবে ‘যত্ন’ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এতে ছাত্রলীগে আদর্শের চর্চা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ছাত্রলীগে দীর্ঘদিন ধরে একটি কথা ঘুরেফিরে আসছে, সেটি হলো ‘অনুপ্রবেশ’। যেকোনো সমস্যা বা ঘটনায় ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশকারীরা ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করে ছাত্রলীগের নেতারা। আর এই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে শিবিরের নাম আসে সবার আগে। এ ছাড়া ছাত্রদলের নামও এসেছে কিছু কিছু সময়, তবে সেটি খুব বেশি পরিমাণে নয়।
অনুপ্রবেশের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, যেকোনো দলের কর্মী একটি দলে যোগ দিতে পারেন। এটি কোনো বিষয় না। কিন্তু কোনো দলের কর্মী যখন তাঁর দল ত্যাগ করে অন্য কোনো দলে যোগ দেন, তাঁর আগের সেই আদর্শিক জায়গা এবং বিশ্বাস পরিবর্তনের দায়িত্ব বর্তমান দলের। অর্থাৎ ছাত্রলীগে যেসব অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেসব ঘটনায় অনুপ্রবেশকারীরা দলে ঢুকে তাঁদের আগের দলের আদর্শ বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন। এই যে দলে আদর্শিক জায়গায় শূন্যতা, এটি ছাত্রলীগ কোনোভাবেই পূরণ করতে পারেনি। যে কারণে বারবার অনুপ্রবেশকারীদের নাম সামনে আসে।
সম্ভাব্য নেতাদের নিয়ে নেতিবাচক পোস্ট কেন?
ছাত্রলীগের ২৯তম কাউন্সিলের দিন থেকে পরবর্তী দু-তিন দিন সম্ভাব্য নেতাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মনে করা হয়, ছাত্রলীগের কথিত সিন্ডিকেট তাঁদের লোক দিয়ে সম্ভাব্য এই নেতাদের নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন। এর ফলে কোনোভাবে যদি সম্ভাবনাময় নেতারা দলের নেতৃত্ব আসতে না পারেন, তাহলে ঘুরেফিরে সিন্ডিকেট থেকেই নেতা নির্বাচিত হবেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার মতো এমন একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে নেতিবাচক প্রচার শুরু হয়। সেখানে একজন নেতার নানা ‘রাজাকার’ ছিলেন বলে গুজব ছড়ানো হয়। অপর এক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য করার এবং অঢেল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। কারও কারও বিরুদ্ধে বিয়ে করার অভিযোগ আনা হয়। কোনো কোনো নেতাকে মামলার আসামি হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই নেতিবাচক প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে কথিত সিন্ডিকেটের প্রার্থীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসা।