ভালো কাজের জন্য মুহিত বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল: অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল
ছবি: সংগৃহীত

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পৃথিবীতে শারীরিকভাবে না থাকলেও, তাঁর ভালো কাজগুলোর জন্য অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

রাজধানীর গুলশানের আজাদ মসজিদে আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম জানাজার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আজ শনিবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা সম্পন্ন হয়েছে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সব সময় তিনি (মুহিত) সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। ওনার যে হাসি, হাসিটা কেউ নকল করতে পারবে না। আমি আন্তরিকভাবে বলি, উনি ভালো মানুষ। আগাগোড়া ভালো। তিনি এই জাতির জন্য, আমাদের দেশের জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের মধ্যেই থাকবেন।’
আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আল্লাহ মেহেরবান, ওনাকে শান্তিতে নিয়ে গেছেন। দোয়া করবেন, যাতে আল্লাহ ওনাকে বেহেশত নসিব করেন।’

এদিকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বেলা দুইটায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখান থেকে দাফনের জন্য মরদেহ নেওয়া হবে তাঁর জন্মস্থান সিলেটে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে জানান, আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবন প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বেলা দুইটায় তাঁর মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। সেখান থেকে দাফনের জন্য মরদেহ নেওয়া হবে তাঁর জন্মস্থান সিলেটে। তবে জাতীয় সংসদ ভবন প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে।

বর্ণাঢ্য জীবন

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবদুল মুহিত বরাবরই একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৬ সালে আবদুল মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সিএসপি হওয়ার পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি পরিকল্পনাসচিব হন। এর আগে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরে মুহিত হন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।

১৯৭৭-৮১ পর্যন্ত আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন এবং ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্তটি ছিল, নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

এরশাদ কথা না রাখলে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এটি দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে মুহিত বই লিখেছেন ৪০টি।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত এখন পর্যন্ত ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকার আমলের।