মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ঘাবড়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই বাংলাদেশ: অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্যের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও গণতন্ত্র সম্মেলনে না ডাকার মতো ঘটনা বাংলাদেশে এখন আলোচ্য বিষয়। এসব ঘটনা এবং সেগুলোর প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও রাজস্ব দপ্তর বাংলাদেশের আইজিপি, র‌্যাবের মহাপরিচালকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ঠিক এই সময়ে এ নিষেধাজ্ঞা কেন? র‌্যাব তো গঠিত হয়েছে অনেক আগে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ: এসব নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া আছে আর সে কারণে সময় লাগতেই পারে। এই সময়ে এসে নিষেধাজ্ঞার কারণ হতে পারে, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। বেশ কিছু কারণেই তিনি এটা করছেন। প্রথমে বলা যায়, ক্যাপিটল হিলের ওপর যে হামলা হলো, তাতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন গণতন্ত্র একটি কার্টুনে পরিণত হয়ে পড়ে। এটা তো অস্বীকার করলে চলবে না। এটা অন্য কোনো দেশে হলে তার পেছনে একেবারে ব্যর্থ রাষ্ট্র তকমা জুড়ে দেওয়া হতো। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অচিন্তনীয় বিষয়। আরেকটি বিষয় কিন্তু অনেকেই খেয়াল রাখছে না। সেটি হলো, এখন পর্যন্ত জো বাইডেনকে স্বীকার করে নেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন পর্যন্ত বলছেন, তিনি অবৈধ প্রেসিডেন্ট। তাঁর পেছনে প্রায় সাত কোটি ভোটারের সমর্থন আছে। এর কিছু প্রভাব আমরা দেখছি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে টিকা না নেওয়া থেকে শুরু করে নানা কর্মকাণ্ডে এসব চোখে পড়ছে। গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষাকারী যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থা তো কাঙ্ক্ষিত নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থান থেকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে এসব কাজ করছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: হ্যাঁ, আবার এর পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে যে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় বাধ্য হয়ে চলে যেতে হলো, সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিরও একটা প্রলেপ তো চাই। রাতের অন্ধকারে চলে যাওয়া, আফগান সরকারের না জানা—এসব পরিস্থিতিকে সামলাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তাই এই আফগানিস্তানে পরাজয়, ক্যাপিটল হিলে হামলা, ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারসের মতো বিষয়গুলো—সব মিলে তার গণতন্ত্রকে উদ্ধারের চেষ্টা সে করবেই। আর এমন একটা সময় এসে পড়েছে, যখন চীন বড় ধরনের একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র নিয়ে একই অবস্থায় পড়ে ছিল। তখন কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনৈতিক শক্তি ছিল না। আর চীন তো আশপাশেই ছিল না। কিন্তু চীন এখন একটি বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। ঠিক এ সময়ে গণতন্ত্রের এই সম্মেলনের মূলে আছে চীনের বিরোধিতা। চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের পাশাপাশি এখানে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা তো ঠিক, বাংলাদেশের লবি খুব দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে তাদের দূত কী বললেন, বিষয়টি তেমন নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একটি কথা আওয়ামী লীগ ঘরানার কেউ কেউ বলছেন যে বিএনপিঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের লবি এসব নিষেধাজ্ঞার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমার কাছে কোনো প্রমাণ যেহেতু নেই, একজন গবেষক হিসেবে আমি এটা বলতে পারি না। সেটা যদি নাও বলি, তবে এটা তো সত্যি, বাংলাদেশের ভেতরেই র‌্যাবের একটি সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই আছে। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোই র‌্যাবের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বলার মধ্যে একধরনের আপাতবিরোধ আছে। বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। আমার কথা হলো, বাংলাদেশের বিষয়টা বাংলাদেশে সমাধান হওয়া উচিত। তাদের অনেক বেশি হয় বলে আমাদের দেশেও হতে হবে, সেটা কখনোই হতে পারে না। আমাদের দেশে একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যা হতে পারবে না—এই পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু কেউ যদি বাংলাদেশের এসব ঘটনা নিয়ে অন্য দেশের কাছে ধরনা দেয় এবং সেসব দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা না বলে, তবে সেটা অন্যায্য হবে। কোন নৈতিক অবস্থান নিয়ে এসব দেশ কথাগুলো বলছে, সে প্রশ্নও থাকা উচিত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে এসবের পেছনে রাজনীতি আছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: অবশ্যই। একটি দেশে এত বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে, সে আবার অন্য দেশের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, এটা রাজনৈতিক বিষয় না হয়ে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে গুমের সংখ্যা বিপুল। লবির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিরোধী দলের লবির চেয়ে বিভিন্ন দেশের লবিগুলো কাজ করেছে। এটা হতেই পারে যে তারা হয়তো বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনেছে। আর এসব দেশের নেতিবাচক অবস্থানের বিপক্ষে বাংলাদেশের কোনো শক্তিশালী লবি ছিল না হয়তো। তা ছাড়া, উত্তর কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো সেটা আশ্চর্যজনক। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মানবাধিকারের রেকর্ড খুব ভালো নয়। আমি যদি কাশ্মীর বা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হত্যার কথা বলি, তাহলে সেগুলোও তো বিচারবহির্ভূত হত্যা। আমাদের সীমান্তে যে পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয়, সেগুলো নিয়ে তো যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো বলতে শুনি না। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলতে গেলে ভারতীয় লবির তৎপরতায় সেটি পাসই হবে না। আসলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমান নিষেধাজ্ঞা আমাদের দুর্বল লবির কারণে হতে পারে। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের একটি বক্তব্য এখন অনেক ভাইরাল হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইউএস অ্যাট অল (আমি যুক্তরাষ্ট্রকে একেবারে বুঝতে পারি না)। আমারও এমনটা মনে হয়। তারা সব যে বুঝেশুনে করে, তা মনে হয় না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ সরকারের জন্য নেতিবাচক বার্তা বহন করছে না বলে মনে করেন? এ ঘটনায় সরকার যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেটাকে কেমন করে দেখেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমাদের সরকার যা করেছে, তা ঠিকই আছে। মার্কিন সরকারও নিশ্চয়ই দেখতে চাইছিল বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া। পররাষ্ট্রসচিব মার্কিন দূতকে তলব করেছেন। এর আগে একইভাবে চীন ও যুক্তরাজ্যের দুই রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল বাংলাদেশ। এর কারণ হলো ১৯৭০–এর দশকের বাংলাদেশ এবং এখনকার বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখেছি, বাংলাদেশ অন্য দেশের সঙ্গে কথা বলার সময় তার শরীরী ভাষায় পরিবর্তন এনেছে। এর একটা বড় কারণ, অপেক্ষাকৃত একটা উন্নয়ন বাংলাদেশে ঘটেছে। তার প্রবৃদ্ধি অনেকেরই আগ্রহের বিষয়। সরকার মহামারি সামলেছে যেভাবে, সেটা নিয়েও খুব বেশি সমালোচনা নেই। এবার নিষেধাজ্ঞার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা খুশি নয়। মার্কিন দূত নিজেও জানেন না এ বিষয়ে। বাংলাদেশ যদি এভাবে না ডাকত, তাহলে ধরে নেওয়া যেত যে বাংলাদেশ ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ানোর অবস্থায় কিন্তু বাংলাদেশ নেই।
আরেকটা বিষয় বলে রাখি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাস বর্ণিল নয়। ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে কথা আছে। এর চেয়ে বড় বিষয়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তাদের ভূমিকা। এটা তো অনেকেই ভুলতে পারবে না। পর্যাপ্ত খাবার থাকার পরও তারা দেয়নি। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা সে সময় বলতেন, বাংলাদেশ একটি বাস্কেট কেস। আজ ৫০ বছরের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে এসেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তারা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ মার্কিন সম্পর্কে বড় ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি করবে না বলে আপনার মনে হয়?

ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট ‘কোয়াড’–এ যোগ দিলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের পর তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আমাদের বহুস্তরের সম্পর্ক আছে। ব্যবসা–বাণিজ্য তো আছেই, আমাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে, প্রচুর বাংলাদেশি সেখানে আছেন। তাই এ নিষেধাজ্ঞার কোনো বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। কিছুদিন এ নিয়ে আলোচনা হবে। পত্রপত্রিকায় লেখা হবে। তারপর মিইয়ে যাবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলবের মাধ্যমে বাংলাদেশ খুব শক্ত করে জানিয়ে দিয়েছে, তোমরা বলে যাবে আর আমরা শুনব, তা হবে না। যখন বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলা হয়েছিল, তখন কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। এবার করেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একটা কথা মনে করা হয় যে চীনের সঙ্গে আমাদের বেশি ঝুঁকে পড়াটা যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নিচ্ছে না। বর্তমান ঘটনার পেছনে তার কিছু প্রভাব আছে বলে মনে হয়?

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের মূল ভিত্তি কিন্তু অর্থনীতি। আমরা কোনো সামরিক জোটে কিন্তু নেই। যুক্তরাষ্ট্রকে যেটি অসন্তুষ্ট করতে পারে, তা হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি। এ দেশে যারা তাদের বন্ধু আছে, এমনকি দলের মধ্যেও, তারা বলে যে এভাবে না থেকে একটি দিক বেছে নেওয়া ভালো। তারা এটা বুঝতে পারে না যে বাংলাদেশ এর দায়ভার নিতে পারবে না। তারা হয়তো এটাও জানে না, এই নীতি স্বাধীনতার পর কিন্তু নেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই এটি ছিল। শুধু তা–ই নয়, সে সময় ইশতেহারে লেখা হচ্ছে, ‘আমরা সিয়াটো বা সেন্টো কোনোটিতেই থাকতে পারি না।’ সেই সময় সারা বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধে উত্তপ্ত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ বলতে পেরেছিলেন। তাহলে আজকের দিনে এটা বলতে অসুবিধা কোথায়।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে প্রথমবারে মতো ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় ইন্দিরা গান্ধীর সামনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে পারস্পরিক বৈরিতা ভুলে একসঙ্গে উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের বৈরিতার অবসান চেয়েছিলেন সেই সময়। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সে কথা ছিল যুগান্তকারী। কারণ, তখন কেবল যুদ্ধ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আছে। ভারত অনেক সহযোগিতা করেছিল সেই যুদ্ধে। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সামনে দাঁড়িয়েই এ কথা বলেছিলেন তিনি। সেই সাহস কোনো নেতার মধ্যে আর দেখা যায়নি।