‘মুরব্বি’র ভূমিকা নিতে চান না নতুন সিইসি

সুন্দর নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা দেখতে চায় নির্বাচন কমিশন।

সিইসি হাবিবুল আউয়াল
ছবি: প্রথম আলো

ভোটের মাঠে নির্বাচন কমিশন একা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পারে না বলে মনে করেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা অসীম নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে, তাহলে সিইসি হিসেবে তিনি মুরব্বির ভূমিকা নিতে পারবেন না।

দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আসে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর দুপুরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কমিশন। এ সময় সিইসির সঙ্গে ছিলেন চার নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই কমিশনের অধীনে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা আছে।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এবং নিজের বক্তব্যে বারবার রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন সিইসি। কিন্তু ভোটে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ইসি কতটুকু শক্ত অবস্থানে থাকবে, বাড়তি কোনো উদ্যোগ থাকবে কি না, এসব বিষয় কমই এসেছে তাঁর বক্তব্যে। অবশ্য তিনি বলেছেন, নতুন কমিশনের কর্মপদ্ধতি কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে তাঁরা নিজেদের সামর্থ্য, দক্ষতা, শক্তি যতটুকু আছে, তা দিয়ে আইনের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। সবাইকে নির্বাচনমুখী করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না। নতুন ইসিকে আস্থায় নিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখার আহ্বান জানান তিনি।

আস্থা অর্জনে ইসির বিশেষ কোনো উদ্যোগ থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘পলিটিক্যাল লিডারশিপে (রাজনৈতিক নেতৃত্ব) যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে, আমি তো তাঁদের মুরব্বি হতে পারব না। ওনারা আমাদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী, অনেক বেশি অভিজ্ঞ। আমরা তাঁদের কাছে অনুনয়-বিনয় করব, আপনারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করুন, চুক্তিবদ্ধ হোন যে আপনারা সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করবেন। ওখানে সহিংসতা করবেন না, কেউ কাউকে বাধা দেবেন না।’

সিইসি বলেন, মুখ ফিরিয়ে থাকলে দূরত্ব বাড়তে থাকবে। আলোচনা করতে হবে। কাউকে না কাউকে অহংকার ত্যাগ করে আলোচনা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের শক্তি অসীম নয়। এটা সব সময় আপেক্ষিক।

ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ইসি কী করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এককভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি করতে পারে না। আমাদের কনসার্ন যে এজেন্সিগুলো আছে, সবাই চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, যেটাকে আমরা বলি পলিটিক্যাল লিডারশিপ অব দ্য কান্ট্রি, এর মানে আওয়ামী লীগ একা নয়। বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি মিলে একটি পলিটিক্যাল লিডারশিপ থাকে। এ লিডারশিপে কিন্তু একটা সমঝোতার চেষ্টা করতে হবে।’

জাতীয় নির্বাচনকে অর্থবহ করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের করণীয় পালনের আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘আপনাদের কিছু যদি ব্যর্থতা থাকে তবে সেটাও স্বীকার করুন। সবাই যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রি–স্টোর করুন।’

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আগামী ভোট কি দিনে হবে, নাকি রাতে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সেটা সময় বলে দেবে। ভোট ভোটের নিয়মে হবে। তিনি বলেন, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসে দেখেছেন দিনে ভোট হয়েছে।

দিনের ভোট-রাতের ভোটের বিষয়ে যেতে চান না উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘যদি মানুষের আস্থা বিনষ্ট হয়, তাহলে সেটি ফেরানোর চেষ্টা কি আমরা করব না? আমাদের আপনারা পর্যবেক্ষণে রাখুন, আমরা তো সেখানে বাধা দেব না। রাজনৈতিক দলগুলো চুক্তিবদ্ধ হতে পারে যে, তারা কেন্দ্রে কোনো সহিংসতা করবে না, সংঘাত তৈরি করবে না।’

রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের কর্মী–সমর্থকদের ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘মাঠ ছেড়ে চলে আসলে হবে না। মাঠে থাকবেন, কষ্ট হবে। এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু উনি পালাননি। তিনি বলছেন, “আমি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করব।” তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধ করে যাচ্ছেন।’

সিইসি বলেন, নির্বাচনের ক্ষেত্রও একটি যুদ্ধ, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেখানে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে ইসি চেষ্টা করবে। একজনের শক্তি দেখে চলে গেলে হবে না। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকতে হবে।

ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বলে আসছে, ইসি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিইসি বলেন, ‘বিএনপি যদি এমন ঘোষণা দিয়েও থাকে, আমরা কি তাদের চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাব না? কোনো কথাই শেষ কথা নয়।’

সিইসি বলেন, নির্বাচন সরকার করে না। নির্বাচনের সময় একটা সরকার থাকে। কোনো না কোনো সরকার থাকবেই। এখন যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা, সেটা মেনে তাঁরা চেষ্টা করবেন, ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সিইসি বলেন, তাঁরা চেষ্টা করবেন ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বিরোধী দলের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা সরকারের সুবিধাভোগী এবং নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না—এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘আপনি কি মনে করছেন, আমি নিজে গিয়ে দিনের ভোট রাতে মারব? বা আমি দেখেও বলব, যে তাড়াতাড়ি করে ঢোকান? আমি সরকারি কর্মচারী ছিলাম। অতীতে যাঁরা এখানে ছিলেন, তাঁদের কে সরকারি কর্মচারী ছিলেন না? কেউ কেউ বলেন, শামসুল হুদা সাহেবের (সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা) নির্বাচন ভালো ছিল, কেউ বলে সাহাবুদ্দীন সাহেবেরটা। (সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন। এর পরে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন) এগুলো আপেক্ষিক।’

নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ইভিএমের বিষয়টি তিনি নিজে ভালো বোঝেন না। ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে কমিশনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ কমিশনার উপস্থিত থাকলেও তাঁরা নিজেরা কোনো বক্তব্য দেননি। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরও জবাব তাঁরা দেননি।

সংবাদ সম্মেলনের পর বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নতুন সিইসি ও কমিশনাররা। আজ মঙ্গলবার সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবে নতুন কমিশন।