মেয়র জাহাঙ্গীরকে আ.লীগ থেকে বহিষ্কার

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম
ফাইল ছবি

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আজ শুক্রবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন।

এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে কয়েক দফা। ৩ অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ১৮ অক্টোবরের মধ্যে জাহাঙ্গীরকে এর জবাব দিতে বলা হয়। তিনি জবাবও দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ‘সুপার এডিট’ করা বলে বারবার দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম।

এদিকে ওই ভিডিওর জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়। গাজীপুরে সরকারি নানা কার্যক্রমে জাহাঙ্গীর আলমকে প্রকারান্তরে এড়িয়ে চলার ঘটনাও ঘটতে থাকে। তাঁর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে অনড় থাকেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা।

গাজীপুরে দীর্ঘদিন ধরে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। ভিডিও প্রকাশে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা।

ত্রিধাবিভক্ত গাজীপুর আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এ ঘটনায়। গাজীপুরের আওয়ামী লীগে একসময় জাহাঙ্গীরের সুহৃদেরাও তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এর পাশাপাশি জাহাঙ্গীরের ভাষায় দলের ‘বিরুদ্ধবাদীরা’তো আছেনই। বড় একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা এবং তাঁদের অনুসারীরা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এককাট্টা হন।

জাহাঙ্গীর আলম স্কুল থেকে কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জেলার ছাত্রলীগ ও পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান পান। এরপর গাজীপুরের সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে গাজীপুর সিটির মেয়র হন তিনি ২০১৮ সালে।

প্রয়াত ময়েজউদ্দীন, রহমত আলী, আহসান উল্লাহ মাস্টার এবং এখনকার মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আজমত উল্লা খান, আখতারুজ্জামান—এঁরা সবাই গাজীপুর জেলার আওয়ামী দুর্গ পাহারা দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। যেকোনো গণ–আন্দোলনে ঢাকার কাছের শ্রমিক অঞ্চল গাজীপুরের টঙ্গীর শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন আহসান উল্লাহ মাস্টার। সাহসী এ নেতাকে ২০০৪ সালের মে মাসে প্রকাশ্যে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

তাঁর ছেলে এখনকার যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে বলা হতো ‘চেয়ারম্যানদের চেয়ারম্যান’।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান দীর্ঘকাল ধরে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন চেয়ারম্যানদের সমিতির প্রধান। ডাকসাইটে এসব প্রবীণের মধ্যে জাহাঙ্গীর উঠে আসেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। পোশাকশিল্পের উপজাত ঝুটের ব্যবসা করে বিপুল অর্থের মালিক হন জাহাঙ্গীর।

নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন করে সমান্তরাল একটি শক্তি সৃষ্টি করেন। তাঁর দেওয়া আর্থিক সুবিধা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও পান বলে বলা হয়। এমন অবস্থায় বর্ষীয়ান আজমত উল্লার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনের সময়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রূপকার ছিলেন আজমত উল্লা। সে বছরে প্রথমবার সিটির নির্বাচন হয়। প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু পারেননি। দল বেছে নেয় আজমত উল্লাকে। নির্বাচনে তিনি হেরে যান। নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ভূমিকা নিয়ে দল তখন প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ সময় জাহিদ আহসান রাসেল ছিলেন জাহাঙ্গীরের পক্ষে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নির্বাচন-পরবর্তী এক মূল্যায়ন এমন ছিল, জাহিদ আহসান রাসেল ও জাহাঙ্গীর আন্তরিক হলে সিটি নির্বাচনের ফল ভিন্ন হতে পারত।