যাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এত অপকর্ম, তাঁর কী হবে

বাবর, বরকত, রুবেল গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের আশ্রয়দাতা খন্দকার মোশাররফের কী হবে—এ প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন

দরপত্র-বাণিজ্য, চাকরি-বাণিজ্য, অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে ফরিদপুরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বড় ভাই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খন্দকার মোহতেশাম বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন। এর আগে অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হন খন্দকার মোশাররফের পাঁচ অনুসারী মোকাররম মিয়া, সত্যজিৎ মুখার্জী, ফোয়াদ, বরকত ও রুবেল। এ অবস্থায় ফরিদপুরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে, যাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এসব ব্যক্তি এত অপকর্ম করেছেন, তাঁর কী হবে? তাঁকে কি আইনের আওতায় আনা হবে?

আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা-কর্মীর অভিযোগ, ফরিদপুর-৩ আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হওয়ার পর ফরিদপুরের রাজনীতি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর ভাই ও সহযোগীরা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এবং প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানেও নিজের পছন্দের লোকদের বসান তিনি। কেউ তাঁর বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বলতে গেলে তাঁকে শক্ত হাতে দমন করেছেন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী হন। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্রমমন্ত্রী এবং সবশেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তাঁকে আর মন্ত্রী করা হয়নি।

বিরোধীদের দমন-পীড়ন

ফরিদপুরের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ত্রাসীদের হামলায় পা হারানো সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হন খন্দকার মোশাররফ। ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট কোনো মামলা হওয়ার আগেই ডিবি পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে প্রবীর সিকদারকে। পরদিন তাঁকে ফরিদপুর নিয়ে আসা হয়। মামলায় ১৭ আগস্ট গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রবীর সিকদারকে। অবশ্য ১৯ আগস্ট প্রবীর সিকদারকে জামিন দেন আদালত।

প্রবীর সিকদারের ওপর ক্ষোভের কারণে কানাইপুরে তাঁর ভাই সুবীর সিকদারের বাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। শহরে বোনের বাড়িতে হামলা করে স্বামী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক তপন দেবনাথকে তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানসহ ফরিদপুর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এরপর বহুদিন এই পরিবারের সদস্যরা ফরিদপুরে ঢুকতে পারেননি।

খন্দকার মোশাররফের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সত্যজিৎ মুখার্জী প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে প্রবীর সিকদারের লেখালেখির কারণে তাঁর ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ খবর জানার পর প্রবীর সিকদার ফেসবুকে লিখেন, তাঁকে হত্যা করা হলে অন্য দুই ব্যক্তির সঙ্গে দায়ী হবেন খন্দকার মোশাররফ। এরপর প্রবীর সিকদারের নামে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়।

সাংবাদিক প্রবীর সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ফরিদপুরের জনগণ মনে করে, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত আওয়ামী লীগবিধ্বংসী যত কর্মকাণ্ড ফরিদপুরে হয়েছে, তার নাটের গুরু খন্দকার মোশাররফ। তাঁর অনুমোদন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ফরিদপুরে দিনের পর দিন এ অন্যায় কাজ পরিচালিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ফরিদপুরে সব অপকর্মের মূল হোতা খন্দকার মোশাররফকে আইনের আওতায় আনা হলে ফরিদপুরবাসী স্বস্তি অনুভব করবে বলে মনে করেন তিনি।

এ ছাড়া খন্দকার মোশাররফ ক্ষমতায় থাকাকালে শহরের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে নিজের লোকদের বসান বলে তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, বাসমালিক গ্রুপ, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি, ফরিদপুর ডা. জাহেদ শিশু হাসপাতাল, ফরিদপুর প্রেসক্লাব, জেলা ক্রীড়া সংস্থা অন্যতম।

খন্দকার মোশাররফের অনুসারী হিসেবে যাঁরা খবরদারি করেছেন, তাঁদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম মিয়া ওরফে বাবু। ২০১৫ সালে ‘ষড়যন্ত্রের’ শিকার হয়ে অপসারিত হন মোকাররম। পরে মন্ত্রীর অনুচরেরা তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ১১টি মামলা দেন। এসব মামলায় মোকাররম আট মাস কারাভোগ করেন।

মোকাররম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মোশাররফের সহযোগী ছিলাম। আমরা যা করেছি, তা মোশাররফের নির্দেশে করেছি। মোশাররফ ভাই যা চেয়েছেন, আমরা সেভাবে কাজ করেছি। আমাদের দাবি, খন্দকার মোশাররফকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ ১২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে আমার প্রশ্রয়ে তারা অপকর্ম করেছে, তারা কি দুগ্ধপোষ্য শিশু? তাদের কি বিচারবুদ্ধি নেই? আমি বললাম, আর তারা করল, তা হবে কেন! তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক এবং নিজের ভালোমন্দ তারা ভালো জানে।’

খন্দকার মোশাররফ আরও বলেন, ‘তারা যা করেছে, নিজের চিন্তাভাবনা ও বিবেচনার আলোকে করেছে। আমি যদি কাউকে ঘরে আগুন দিতে বলি, সে কি আগুন দিয়ে দেবে?’ খন্দকার মোশাররফ দাবি করেন, তাঁকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই।

আইনের আওতায় আনার দাবি

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেনের অভিযোগ, মোশাররফ-বাবরের কারণে তাঁর পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর ভাই হারুন হোসেন ছিলেন তিতুমীর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বাজার ইজারা নিয়ে তাঁর ভাইকে চরমভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমাকে শায়েস্তা করার জন্য আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। মোশাররফ ও বাবর যে অন্যায়-অত্যাচার করেছেন, তা সর্বজনবিদিত। ফরিদপুরের মানুষ এ-জাতীয় অপকর্মের অবসান চায়।’

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন, তাতে অন্যায় করে কেউ পার পাবেন না। জনগণ চায় সব অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য মোশাররফকে আইনের আওতায় আনা হোক।