শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ধর্মপ্রাণের চেয়ে ধর্মান্ধ মানুষ বেশি: হানিফ

মাহবুবউল আলম হানিফ
সংগৃহীত

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার পেছনে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ৷ কারণগুলো হলো শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, লোকসংস্কৃতির চর্চা কমে যাওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং মানুষের নৈতিকতা-মূল্যবোধের অবক্ষয়। তিনি বলেছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ধর্মপ্রাণ মানুষের চেয়ে ধর্মান্ধ বেশি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে মাহবুব উল আলম হানিফ সাম্প্রদায়িকতার পেছনে এই পাঁচ কারণের কথা বলেন৷ ‘গৌরব ৭১’ নামের একটি সংগঠন ‘সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।


গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের চেয়ে ধর্মান্ধ বেশি। এর মূল কারণ হলো শিক্ষাব্যবস্থা। জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং সেটাই হয়ে আসছে। ইতিহাস বলে, ভারত-বাংলাদেশসহ সর্বত্রই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূল কারণ ছিল রাজনীতি। রাজনৈতিক কারণে এখনো ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার আরেকটা বড় কারণ, লোকসংস্কৃতির চর্চা কমে যাওয়া। এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজ মাহফিল। আরেকটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এসব মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের কারণে দেশে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ তৈরি হচ্ছে। মানুষের ন্যায়নীতি, সততা ও ন্যূনতম মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়াও সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ।

সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘একজন মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলে তাঁর মন থেকে কুসংস্কার দূর হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে একটা নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করি। মাদ্রাসার শিক্ষকেরা রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা ছাত্রদের বাধ্য করেন। মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা হলেই সাম্প্রদায়িক, তা নয়। এ শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা উচিত। ওয়াজের বক্তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য ও অশ্লীল-সুড়সুড়িমূলক কথাবার্তা বলে থাকেন। মানুষকে ধর্মপরায়ণ না করে ধর্মান্ধ করে তোলার একটি হাতিয়ার হিসেবে ওয়াজ মাহফিলকে ব্যবহার করা হচ্ছে।


হানিফ বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফিল্টারিং হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। ফেসবুক চালাতে হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিবন্ধন করতে হয় এবং সরকারের নজরদারি থাকে। এখান থেকে তারা শতকোটি টাকার ব্যবসা করে যাবে, আর সেই ব্যবসার বলি হিসেবে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত-অপকর্ম হবে, কিন্তু সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, এই ধরনের ব্যবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই, ফেসবুকের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিন। ন্যায়নীতি, সততা ও ন্যূনতম মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে মানুষকে গ্রাস করেছে উচ্চাভিলাষও। আমরা সবাই যেকোনো উপায়ে রাতারাতি বিশাল সম্পদের মালিক হতে চাই। কিছু মানুষ হয়তো এটা পারছে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ যাঁরা দুর্নীতি করতে পারছেন না, তাঁরা হতাশার মধ্যে চলে যাচ্ছেন। এ হতাশাই মানুষকে ধর্মান্ধতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’


এসব ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ দাবি করে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘মানুষের নীতি-নৈতিকতাবোধ জাগিয়ে তোলা এবং মানবসম্পদের উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের মানবসম্পদ যেভাবে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে একটা রাষ্ট্র বেশি দূর এগোতে পারে না।’

গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার যে দেশগুলো রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করেছে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে না পারায় এখানে হচ্ছে হত্যা, হানাহানি প্রভৃতি। যেখানে ধর্ম রাষ্ট্রের সঙ্গে যত যুক্ত হবে, সেখানে ষড়যন্ত্র তত বাড়বে। আমাদের তৃণমূল মানুষের কাছে ও আক্রান্ত পাড়ায় যেতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে।’


হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। সেই একই দুর্বল চিত্রনাট্যের এসব ঘটনার কুশীলবদের অভিনয়ও কাঁচা। প্রতিহত না করে প্রশাসন কুমিল্লার ঘটনাটিকে উসকে দিয়েছে। কোরআন শরীফ উদ্ধারের ঘটনায় একজন পুলিশ সেটাকে লাইভ করতে দিলেন, পুলিশ ছিল নায়কের ভূমিকায়। নোয়াখালীতে তাণ্ডবের সময় তিন ঘণ্টার ভেতর প্রশাসনের একজনও আসতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ জায়গায় জায়গায় আপস করে বলে অভিযোগ করেন সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিটি সেক্টরে আপস আছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির পেছনে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি না থাকলে তারা এগোতে পারে না।


গৌরব ৭১-এর সভাপতি মনিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিল আলোচনায় অন্যদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক আমিনুল ইসলাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নুজহাত চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতা জাহাঙ্গীর আলম, যুবলীগের সহসভাপতি কোহেলী কুদ্দুস, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।