সহিংসতার পর এবার হেফাজতের বিষয়ে কঠোর সরকার

হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্ব সরকারের পছন্দের নয়। তাঁদের ওপর সরকারের সেভাবে নিয়ন্ত্রণও ছিল না। তারপরও সরকার হেফাজতকে পুরোপুরি বৈরী অবস্থানে ঠেলে দিতে চায়নি। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর এবার সংগঠনটির ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও লক্ষ্য রয়েছে বলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এরই মধ্যে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় সারা দেশে তিন শতাধিক হেফাজত নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। কেন্দ্রীয় ও মাঝারি সারির কিছু নেতাকেও আইনের আওতায় এনে শীর্ষ নেতাদের প্রতি একটা বার্তা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট চারজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বলে জানা গেছে।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে, হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রায় সবার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে থাকা পুরোনো মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে। সব দিক থেকে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে আগের মতো একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েও এগোচ্ছে সরকার। এ জন্য রমজান মাস ও করোনার কারণে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো হবে। হেফাজত যেকোনো পরিস্থিতিতে মূলত মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকে। কওমি মাদ্রাসাগুলো এখন রমজানের ছুটিতে রয়েছে। তাই এ সময়টাকে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া হেফাজতের নেতৃত্বের আইনি ব্যবস্থা জোরদার করার ক্ষেত্রে সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বিতর্ক সরকারের জন্য সহায়ক হয়েছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা হেফাজত নেতাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় অন্য নেতাদেরও ‘দুর্বল’ দিক খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিক কেলেঙ্কারি, মাদ্রাসা পরিচালনায় অনিয়ম, মাদ্রাসার তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম থাকলে সে বিষয়গুলোও সামনে আনা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একটা অংশ মনে করেন হেফাজতকে চাপে রাখার বিকল্প নেই। কারণ, ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরের অবস্থান ও ব্যাপক সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে হেফাজতে ইসলাম কিছুটা পিছু হটেছিল। এরপর সরকার হেফাজতের নেতৃত্বের একটা অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এরপর হেফাজতের অনেক দাবি সরকার মেনেও নিয়েছিল। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস করে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমান করা হয়। যার ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ ‘শোকরানা মাহফিলের’ আয়োজন করে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়।

তবে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের নতুন কমিটিতে সরকারঘনিষ্ঠ নেতারা স্থান পাননি। এরপর সরকারের সঙ্গে হেফাজতের পর্দার অন্তরালের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান নিয়ে হেফাজত একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও দ্রুত সে অবস্থান থেকে সরেও আসে। সরকারের দিক থেকেও তখন কঠোর না হয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে গত মাসে নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে হেফাজতের অবস্থান এবং পরে সহিংসতার ঘটনায় সংগঠনটির ব্যাপারে সরকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে।

এই চাপে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলেও তাঁদের মধ্যে একটা ফাটল ধরানো যাবে বলে মনে করেন সরকারি দলের একটা অংশ। আবার কেউ কেউ নরমে-গরমে পরিস্থিতি মোকাবিলার পক্ষে। চাপ তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনমতো পর্দার অন্তরালে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কৌশল নেওয়া হবে বলে সরকারি একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে রাষ্ট্র, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে। তাদের ধ্বংসযজ্ঞের মাশুল দিতে হবে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, হেফাজতে ইসলাম ঘোষিতভাবে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও এর শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগই ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। তাদের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। ফলে তাদের সঙ্গে একেবারে গাঁটছড়া কখনোই হবে না। তবে একধরনের কৌশলগত সম্পর্ক রাখাটা রাজনৈতিক কারণে দরকারও হয়।

অবশ্য আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে সরকার হেফাজতের ব্যাপারে নির্মোহ, সেটা মনে করার মতো পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। হেফাজতের ভেতর ফাটল তৈরি করে নিজেদের পক্ষে আনার একটা ইচ্ছা ও চেষ্টা সরকারের মধ্যে আছে। এটা আত্মঘাতী হবে। কারণ, আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে আস্তে আস্তে হেফাজতপ্রীতি বেড়ে যাচ্ছে। তাই কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে সরকারের এ–বিষয়ক নীতি স্পষ্ট করতে হবে।