সোনালি অধ্যায়ে টানাপোড়েনের খচখচানি

  • ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে বারবার চলে আসছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি।

  • বাংলাদেশ–ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সাহচর্যের কারণে সম্পর্কের ঐতিহাসিক সম্প্রসারণই শুধু ঘটেনি, নতুন নতুন আঙিনায় তা প্রসারিতও হচ্ছে।

  • ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ‘সফরের চরিত্র ঠিকমতো উপস্থাপন করা গেলে জল্পনা পাখা মেলার সুযোগ পেত না।’

  • সফর ঘিরে বিতর্কের দায় দুই পক্ষেরই।

দেব মুখোপাধ্যায়, বীণা সিক্রি ও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। সেখানে উঠে আসছে সম্পর্ক জোরদারের নানা উপায়।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ‘হঠাৎ’ ঢাকা সফরের এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতে শ্রীলঙ্কার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়নাথ কলম্বাগে যে বিবৃতি দিলেন, ভারতের কানে এর চেয়ে শ্রুতিমধুর কিছু সাম্প্রতিক কালে এই দ্বীপরাষ্ট্র থেকে বর্ষিত হয়েছে কি না, সন্দেহ। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে জয়নাথের বিবৃতিতে স্পষ্ট, অতীতের অভিজ্ঞতা তাঁদের শিক্ষিত করেছে। কেননা, তিনি বলেছেন, ‘হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল’ এবং ‘আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতাধরদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কলম্বো নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবে।’ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের উদ্ধৃতি দিয়ে জয়নাথ বলেছেন, তাঁরা ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করছেন। কারণ, ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তার নিরিখে শ্রীলঙ্কা ভারতের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চায় না।’
শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের এই বোধোদয় দুটি বিষয় প্রমাণ করছে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের গুরুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ নয়। দ্বিতীয়ত, ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি অনুযায়ী ‘প্রতিবেশী প্রথম’ কর্মসূচিগুলো পারস্পরিক স্বার্থের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

গণমাধ্যমে আলোড়ন ও চীনা উপস্থিতি

শ্রিংলার ‘হঠাৎ’ ঢাকা সফরের তুল্যমূল্য বিচার উপলব্ধির এই আলোতেই করতে হবে। বিশেষ করে যখন ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে বারবার চলে আসছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি।

ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গণমাধ্যমের একাংশ সম্প্রতি বেশ আলোড়িত। তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে ভারতীয় গণমাধ্যমেও। নানা রকমের আলোচনা হচ্ছে। সম্পর্কের গভীরতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো কোনো মহলের শঙ্কা, সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’-এর ঈশান কোণে অশান্তি ও অসন্তোষের মেঘ উঁকিঝুঁকি মারছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও উন্নয়নের অলিন্দে চীনের উপস্থিতি বাড়ছে। তাতে ভারতের ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে। এই বিতর্ক (কারও কারও কাছে যা নিতান্তই শিশুসুলভ) নতুন করে আতশ কাচের তলায় টেনে এনেছে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে। শুরু হয়েছে সম্পর্কের ব্যাপকতা ও গভীরতার নয়া ময়নাতদন্ত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরুন এক যুগ ধরে এই নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে এক অন্য মাত্রায় তুলে দিয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে গেছে। ভারতে বিদেশি পর্যটকদের তালিকায় বাংলাদেশ আজ এক নম্বরে। সে দেশে ভারতীয় ভিসার চাহিদাও বেড়ে চলেছে দিন দিন।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার

সম্পর্কে টানাপোড়েন, তবু অগ্রগতি

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে আসা সাবেক কূটনীতিক কিংবা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের তন্বিষ্ট পর্যবেক্ষক ও গবেষকেরা এই আলোচনাকে ‘অর্থহীন’ ও সংশয়কে ‘অলীক’ বলে মনে করছেন। তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত, সব সম্পর্কেই টানাপোড়েন থাকে। হয়তো এই সম্পর্কের কোনো কোনো ক্ষেত্রেও তা আছে। কিন্তু এত বছর ধরে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষাকারী এই সম্পর্কে এমন কিছু ঘটেনি, যা পিছু হটার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে কিংবা যা শঙ্কিত হওয়ার মতো।

যেমন বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, আশঙ্কার তেমন কিছুই নেই। তাঁর মতে, ‘দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সাহচর্যের দরুন এই সম্পর্কের ঐতিহাসিক সম্প্রসারণই শুধু ঘটেনি, নিত্যদিন নতুন নতুন আঙিনায় তা প্রসারিতও হচ্ছে। দীর্ঘ প্রলম্বিত স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে সর্বত্র। বিদ্যুৎ, সাইবার স্পেস, রেল, সড়ক, নদী, উপকূল, সমুদ্রপথ পারস্পরিক স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে সহযোগিতা হচ্ছে না।’ পিনাক রঞ্জনের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরুন এক যুগ ধরে এই নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে এক অন্য মাত্রায় তুলে দিয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে গেছে। ভারতে বিদেশি পর্যটকদের তালিকায় বাংলাদেশ আজ এক নম্বরে। সে দেশে ভারতীয় ভিসার চাহিদাও বেড়ে চলেছে দিন দিন।’

বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং দক্ষিণ এশীয় ঘটনাবলির পর্যবেক্ষক শ্রীরাধা দত্তের মতে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্রমোন্নতি স্বাভাবিক ঘটনা। দুই দেশের এমন কিছু কমন চরিত্র রয়েছে, যা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য। পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতাও অনস্বীকার্য। কাজেই সম্পর্কের ব্যাপ্তি ঘটাই স্বাভাবিক।’ দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় সেটাই এক যুগ ধরে হয়ে চলেছে।

কিন্তু তাই বলে কি সম্পর্কে ওঠাপড়া নেই? শ্রীরাধার মতে, ‘অবশ্যই তা আছে। থাকবেও। যেকোনো সম্পর্কে ওঠানামা থাকাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কেও তাই সময়ে সময়ে ছায়া ফেলে তিস্তা, দুঃখজনক সীমান্ত হত্যা, তুলনামূলক অপ্রাপ্তিবোধ। কিন্তু তাই বলে সম্পর্কের প্রবাহ থমকে থাকে না। পারস্পরিক স্বার্থ ও অগ্রগতি যেখানে প্রবল, সেখানে তা থমকে থাকতেও পারে না।’ শ্রীরাধা তাই মনে করেন, ‘এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শুধু সময়ের পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগের সম্ভাবনাকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।’

সম্পর্কের গভীরতা ও ব্যাপ্তির কারণেই হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ‘হঠাৎ’ সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহী নন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের আরও এক সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি। শ্রিংলার সফরের নানাবিধ অর্থ যাঁরা খুঁজতে চাইছেন, সেই মহলের কোনো গুরুত্ব তাঁর কাছে নেই। কেননা, বীণা মনে করেন, ‘এই সফর দুই দেশের মধ্যবর্তী নিরবচ্ছিন্ন বার্তালাপেরই অঙ্গ।’ তাঁর মতে, ‘করোনাজনিত যাবতীয় বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শ্রীংলার ঢাকা যাত্রা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা এটাই বোঝায় প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশকে ভারত কতটা গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশকে ভারত কোন চোখে দেখে।’
শ্রিংলার সফর নিয়ে পিনাক রঞ্জনের অভিমতও প্রায় অনুরূপ। ওই সফরকে তিনি ‘সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার অঙ্গ’ হিসেবেই দেখতে চান। তাঁর মতে, ‘কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মসূচির আলোয় এই সফরকে দেখা দরকার।’ পিনাকের ধারণা, ‘কোভিড-সংক্রান্ত প্রতিষেধকের ট্রায়াল নিয়ে সম্ভবত জরুরি কোনো আলোচনার প্রয়োজন ছিল। হয়তো ছিল উন্নয়ন কর্মসূচি, যোগাযোগ, অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত জরুরি বিষয়ও।’

স্বচ্ছতার অভাব, দায় দুপক্ষের

কিন্তু প্রয়োজন যা-ই হোক, শ্রীরাধা মনে করেন, ‘সফর ঘিরে কিছুটা স্বচ্ছতা অবশ্যই দরকার ছিল। ঠিক সময়ে জরুরি প্রশ্নের উত্তর মিললে এই ধরনের অহেতুক জল্পনা দানা বাঁধার কোনো অবকাশ থাকে না। পররাষ্ট্রসচিবের ওই সফর ঠিক সময়ে জল্পনার অবসান ঘটাতে পারেনি। তাই অপ্রয়োজনীয় সব আলোচনা গণমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে।’ শ্রীরাধা মনে করেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বিশ্বাসের ওপর স্থাপিত। এই ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মোকাবিলা তাই স্বচ্ছতার সঙ্গেই করা উচিত।’

পররাষ্ট্রসচিবের সফর ঘিরে এই বিতর্কের ‘দায় ভারত ও বাংলাদেশ—কেউই এড়াতে পারে না’ বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক ও বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘অনাবশ্যক’ ওই বিতর্কের জন্য দুই দেশেরই কিছুটা ইন্ধন রয়েছে। কেননা, তিনি মনে করছেন, ‘কোভিড প্রতিষেধকের ব্যবস্থাপনা বা বাংলাদেশকে ওই বিষয়ে সহায়তার প্রস্তাবের জন্য পররাষ্ট্রসচিবের সফরের প্রয়োজন ছিল না। কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করারও দরকার ছিল না। ওই সফরে নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি (এনআরসি) নিয়েও আলোচনা হয়নি বলে ভারত জানিয়েছে। কথা হয়নি বাংলাদেশে চীনা উপস্থিতি নিয়েও। তাহলে করোনাকালের কঠিন সময়ে এই হঠাৎ সফরের তাগিদ ও প্রয়োজনটা কোথায় ছিল?’ এই সব প্রশ্নের সদুত্তর নেই বলেই দেব মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, ‘সফরের চরিত্র ঠিকমতো উপস্থাপন করা গেলে জল্পনা পাখা মেলার সুযোগ পেত না।’

বিরোধিতার নতুন অস্ত্র সিএএ, এনআরসি

দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্কের কয়েকটা বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রথমত, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এই সম্পর্ক আদ্যিকালের। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও আত্মিক দিক দিয়ে এই সম্পর্ক প্রতিনিয়ত যাচাই হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্পর্ককে বহুমাত্রিক করে তুলেছেন। ফলে সহযোগিতার নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এক অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছে দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্ক যা কিনা সমসাময়িক পৃথিবীর ‘রোল মডেল’। এবং তৃতীয়ত, এত কিছু সত্ত্বেও এই বিশ্বস্ত ও বন্ধুদেশে ভারত বিরোধিতার তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে।

বিরোধিতার এই সত্য আড়াল করা সম্ভবত উটপাখিসদৃশ্য আচরণের সঙ্গে তুলনীয়। ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) গবেষক স্মৃতি পট্টনায়ক এই সত্যকে গয়নার সোনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘সোনায় খাদ না থাকলে গয়না মজবুত ও টেকসই হয় না। সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়েও খাদ আছে। শুধু দেখা দরকার, খাদের পরিমাণ যেন ঠিক থাকে। কখনোই যেন মাত্রাছাড়া না হয়। বিসদৃশ না লাগে।’ স্মৃতি পট্টনায়ক বিস্মিত হন এটা ভেবে যে, ‘যে দেশকে ভারত সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয়, সেই দেশেই বিরোধিতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি!’ তাঁর ভাষায়, ‘এ এক অদ্ভুত পরিহাস!’

এই বিস্ময় দেব মুখোপাধ্যায়কেও বিহ্বল করে। তাই তিনি বলেন, ‘এটা অবাক করে। কারণ, কিছুদিন আগেও দুই সরকার চলমান সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছে। বছর কয়েক আগে একটা সমীক্ষা করেছিল ভারতের এক বড় সংবাদপত্র। তাতে দেখা গিয়েছিল, বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশকে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিবেশী মনে করে।’ সেই দেশের মানুষের মনে কেন বিদ্বেষ বেড়ে যাবে?

ভারতবিরোধী মনোভাবের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেব মুখোপাধ্যায়ের রয়েছে। ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ওই দেশের এক বিরাটসংখ্যক মানুষের মধ্যে রয়েছে। হতে পারে ১০ বছরের বেশি একটানা শাসন সরকারবিরোধী যে মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে, সেটাই ভারতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’

ভারত বিরোধিতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষক-গবেষকদের কেউ অস্বীকার করছেন না। দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘বাংলাদেশের এই মহল ভারতকে সব সময় নেতিবাচক চোখে দেখে। তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে হিন্দু-ভারত সব সময় সন্দেহজনক। পাকিস্তানের বিভাজনের জন্য তারা ভারতকেই দায়ী করে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই মহলই বিএনপির মেরুদণ্ড।’ একই অভিমত পিনাক রঞ্জনেরও। তিনি মনে করেন, ‘বাংলাদেশের এই মহল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সব সময় ধর্মের আধারে দেখতে পছন্দ করে। সেই দৃষ্টিতে কখনো প্রাধান্য পায় সীমান্ত হত্যা। কখনো জলসম্পদ বণ্টনের জটিলতা। কখনো ভারতের তথাকথিত দাদাগিরি।

কখনোবা ভিসা পাওয়ার সমস্যা।’ বীণা সিক্রির কথায়, ‘এই মহল ৫০ বছর ধরেই এটা করে আসছে। তাদের চোখে ভারত সব সময় ক্ষতিকর। চীন সর্বার্থে ভালো। পাকিস্তান পরম আত্মীয়।’

এই মহলের হাতে ভারতই তুলে দিয়েছে নতুন হাতিয়ার! সিএএ ও এনআরসি। দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ভারতের এই দুই সিদ্ধান্ত এবং সে-সংক্রান্ত ক্রমাগত রাজনৈতিক বিবৃতি ‘ভারতবিরোধীদের হাত শক্ত করার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক শক্তিদের দুর্বল করে দিচ্ছে। এই অসাম্প্রদায়িক শক্তিই কিন্তু সব সময় ভারতের হয়ে কথা বলে এসেছে। আসছেও।’ দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘সিএএ ও এনআরসি দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি মৈত্রী ও বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।’

কিন্তু তা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কের ভিত গভীরে প্রোথিত। সেই কারণে দেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘সম্পর্ক গভীর বলেই মানুষে মানুষে যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। বাণিজ্য বাড়ছে। লগ্নি বাড়ছে। শুধু মনে রাখতে হবে, কিছু মানুষ সব সময় থাকেন, যাঁরা সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখেন। যেমন পররাষ্ট্রসচিবের এই সফরটাকে অনেকে দেখছেন।’ পিনাক রঞ্জনের মতে, ‘এই মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ভারত বিরোধিতাকে বাড়িয়ে তুলছে এবং তৃতীয় দেশকে উৎসাহিত করছে। চীন-পাকিস্তান অক্ষ যে এর পেছনে, তাতে সন্দেহ নেই, বিশেষ করে সেই সময় যখন কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন এবং পূর্ব লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে গেছে।’

মোকাবিলার উপায়

প্রশ্ন হলো, ক্রমবর্ধমান এই বিরোধিতার মোকাবিলা ভারতের কীভাবে করা উচিত। দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, গোপনীয়তার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে ‘খোলামেলা আবহ জরুরি। আর জরুরি, যে বিষয়গুলো জনমত বিষিয়ে তোলে, যেসব সমস্যা স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল, সেগুলোর আশু নিরসনে নজর দেওয়া। যত্নবান হওয়া।’ পিনাক রঞ্জনের মতে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে পাকিস্তানকে চীন উৎসাহ দিয়ে চলেছে। তাদের টাকা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী এবং বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির তাগিদ ইদানীংকালের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবে ধুনো দিচ্ছে। ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই মহলের মোকাবিলা করা। সেটা করা প্রয়োজন পারস্পরিক সুসম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে ও উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরে। ভারত ও বাংলাদেশ—দুই দেশেরই উচিত সক্রিয় থাকা। দুই দেশেরই উচিত রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধীদের জন্য দেশের জমি ব্যবহৃত হতে না দেওয়া।’