১৩১ ইউপিতে নৌকা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই নেই

চারটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জামানত রক্ষা করার মতো ভোটও পাননি।

ইউপি নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এসব ইউনিয়নের নির্বাচনে মূলত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। অন্তত চারটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জামানত রক্ষা করার মতো ভোটও পাননি।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ১৩১টি ইউপিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা ভোটের ফলে দ্বিতীয় স্থানেও ছিলেন না। এই ইউপিগুলো দেশের ৪৩টি জেলায়। এর মধ্যে বড় অংশই রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে। দ্বিতীয় ধাপে উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধা সদরের ১৩টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে মাত্র ৩টিতে। নৌকার প্রার্থী দ্বিতীয় হয়েছেন ২ ইউপিতে। বাকি ৮টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। এসব ইউপিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, দ্বিতীয় স্থানেও ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চারজন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। দলীয় প্রার্থীদের এই অবস্থার কারণ কী, জানতে চাইলে গাইবান্ধা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই দলের প্রার্থীর পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করেননি। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নৌকার ভোট ভাগাভাগি হয়েছে। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তাও ভূমিকা রাখে।

গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৮৩৩টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। ইসি সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভোটে ৪৮৫টি ইউপিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা। অবশ্য নির্বাচনে ৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ কাউকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি। এসব ইউপি উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। সে হিসাবে দ্বিতীয় ধাপে ক্ষমতাসীনেরা জয় পেয়েছেন প্রায় ৫৯ শতাংশ ইউপিতে।

ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন সঠিক ছিল না। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় কোন্দল, অনেক জায়গায় প্রার্থী বাছাইয়ে সাংসদদের প্রভাব, তৃণমূলের মতামত যথাযথভাবে গুরুত্ব না পাওয়ায় এবার দ্বিতীয় ধাপে এসে আগের তুলনায় নৌকা পিছিয়েছে। ওই নেতাদের অনেকে মনোনয়ন–বাণিজ্যের কথাও বলেছেন।

এর আগে প্রথম ধাপে দুই দফায় এ বছরের এপ্রিল ও জুন মাসে ৩৬৫টি ইউপিতে ভোট হয়েছিল। সেখানে ১৩টিতে নৌকার প্রার্থী ছিল না। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল ২৬৯টিতে। সে হিসাবে প্রথম ধাপে ৭৬ শতাংশ ইউপিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে এসে নৌকার জয়ের হার কমেছে। শুধু তা–ই নয়, এর আগে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয়ের হার এর চেয়ে ভালো ছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। অবশ্য সে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২ হাজার ৬৫২টি অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিল।

দ্বিতীয় ধাপে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ৭টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ২টি জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২টিতে তারা দ্বিতীয় স্থানে ছিল। বাকি ৩টিতে দ্বিতীয় স্থানেও ছিল না নৌকা, এর মধ্যে ২টি ইউপিতে নৌকার প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। নীলফামারী সদরের ১১টি ইউপির মধ্যে নৌকা জয় পেয়েছে ২টিতে। নীলফামারী সদরের ৪টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না।

গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোটে ৪৮৫টি ইউপিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

উত্তরবঙ্গের আরেক জেলা বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই জেলার শিবগঞ্জ ও শেরপুর উপজেলার মোট ২০টি ইউপিতে দ্বিতীয় ধাপে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ৯টিতে। ২টিতে আওয়ামী লীগ ছিল দ্বিতীয়। আর ৮টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না। বগুড়ার শেরপুরে ৪টি ইউপিতে বিএনপির নেতা এবং ১টিতে জামায়াত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, দলীয় কোন্দলের কারণে বগুড়ায় ফল খারাপ হয়েছে। এখানে নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগের ফল আরও খারাপ হতো এমন আলোচনাও আছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কোথাও কোথাও দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে বাণিজ্য হয়েছে—এমন অভিযোগও আছে।

তবে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূল থেকে যেসব নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোই কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ ঠিক নয়। তিনি বলেন, ভোটের ফল খারাপ হওয়ার পেছনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের একটি ভূমিকা আছে। বগুড়ায় মূল লক্ষ্য থাকে বিএনপিকে হারানো। বিএনপিকে হারাতে অনেক কৌশল থাকে।

তার মানে বিএনপিকে হারাতে নৌকার প্রার্থীও বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রাগেবুল আহসান বলেন, ‘যেখানে দেখছে যে আমি পারতেছি না, যদি অন্য ভাইকে দিয়ে জেতানো যায়, সেখানে তাকে সমর্থন করছে।’

ময়মনসিংহ অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান আছে বলে ধরা হয়। জেলার ৩০টি ইউপিতে দ্বিতীয় ধাপে ভোটে ১০টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকি ২০টি ইউপিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে ১২টি ইউপিতে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় স্থানেও ছিল না।

ময়মনসিংহ জেলায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে ধোবাউড়া উপজেলায়। এখানকার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের মধ্যে মাত্র একটিতে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বাকি পাঁচটিতে বিএনপির নেতা হিসেবে পরিচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের জয় হয়েছে। একটি ইউপির ফল স্থগিত রয়েছে।

ফাইল ছবি

পাঁচটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তিনটি ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট নিয়ে। এ তিনটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৫৮, ৩৭৬ ও ৩৯২ ভোট।

ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের নেতাদের বক্তব্য, টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ায় এমন ভরাডুবি। অপর পক্ষ বলছে, আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট চাইলেও গোপনে তাঁরা নৌকার চরম বিরোধিতা করেছেন, এ কারণে এমন পরাজয়।

ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন সঠিক ছিল না। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে আমি দলীয় প্রার্থী হলে একটি পক্ষ ভোটারদের কাছে প্রচার করেছিল নৌকায় ভোট দেবেন না। ওই প্রচার ভোটাররা এখনো ভোলেনি।’

২০১৬ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তবে অনেক জায়গায় বিএনপির প্রার্থী ছিল না। ওই নির্বাচনে মোট ২০৭টি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন মোট ইউপির ৫ শতাংশে চেয়ারম্যান পদে ভোট দরকার হয়নি। এবার বিএনপি ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী প্রার্থী বাড়ছে। প্রথম দুই ধাপেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। শতকরা হিসাবে এবার এখন পর্যন্ত ১৪ শতাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

বিনা ভোটে এত বেশিসংখ্যক প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, সারা দেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরনের ‘নির্বাচন’ করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকলেই যথেষ্ট।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান পারভেজ, ময়মনসিংহশাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা]