'গোলন্দাজ বাহিনী'তে পিষ্ট আওয়ামী লীগ

ফাহমি গোলন্দাজ
ফাহমি গোলন্দাজ
>

• এক ভীতসন্ত্রস্ত ও নিপীড়িত জনপদ গফরগাঁও
• সাংসদের নির্যাতনে হাজারো নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া
• অত্যাচার–নির্যাতনে অনেকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়
• নাগরিকেরা ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন
• অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পাননি
• ফাহমি গোলন্দাজ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হন
• ফাহমির বাবা আলতাফ হোসেনও সাংসদ ছিলেন

ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে দুই মাস ধরে চিকিৎসাধীন ফারুক মিয়া। তাঁর দুই পা ভেঙে তিন টুকরা করা হয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ফারুক নিজের সুস্থতার চেয়ে বাড়ি ফেরা নিয়ে বেশি শঙ্কায়। রড, হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পিটুনির পর স্থানীয় সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজের অনুসারীরা জানিয়ে দিয়েছেন, বাড়ি ফিরলে আবার পেটানো হবে।

৪০ বছর বয়সী ফারুকও সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ফারুক মিয়া বলেন, তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেনের অনুসারী। গত ১২ আগস্ট রাতে তাঁকে পেটানোর কারণ ছিল, তিনি ময়মনসিংহ শহর থেকে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার গফরগাঁও নিয়ে গিয়েছিলেন। দলীয় নেতা মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজের রাজনৈতিক বিরোধ আছে।

ফারুকের ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে যেন এক ভীতসন্ত্রস্ত ও নিপীড়িত জনপদের সন্ধান পাওয়া গেল। দলের সাংসদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে এমন কয়েক শ পরিবার গফরগাঁও ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অত্যাচার, নির্যাতনের পরও যাঁরা নিজের ভিটেমাটির মায়া কাটাতে পারেননি, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন; নাগরিক হিসেবে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এই ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু প্রতিকার পাননি।

গফরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সাংসদের নির্যাতনে এলাকাছাড়া মানুষের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে দাবি করেছেন। নাম-ঠিকানা চাইলে তাঁরা ১০০টি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন নম্বর দেন। তাদের মধ্যে ৩২টি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। এসব পরিবারের সবাই গফরগাঁও ছাড়তে বাধ্য হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নির্যাতিত ব্যক্তিদের মধ্যে এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগের নেতা–কর্মীরা আছেন।

ফাহমি গোলন্দাজ ছিলেন গফরগাঁও উপজেলার চেয়ারম্যান। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি সাংসদ হন। তাঁর বাবা আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ ১৯৯১-২০০৮ সাল পর্যন্ত এই আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন। সে সময় দেশজুড়ে যে কজন সাংসদ ‘গডফাদার’ বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন, আলতাফ গোলন্দাজ ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর মৃত্যুর পর ওই আসনে সাংসদ হন আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। তখন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীদের নির্যাতন–নিপীড়নেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বলে দাবি করেছেন গফরগাঁওয়ের দলীয় নেতা–কর্মীরা। তাই সাংসদ পরিবর্তন হওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখন তাঁরা বলছেন, বর্তমান সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজ আগের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, বালুমহাল দখল, জমি দখলসহ সব অপকর্মের অভিযোগের আঙুল তাঁর অনুসারী ‘গোলন্দাজ বাহিনী’র দিকে।

৭ অক্টোবর গফরগাঁও যান এই প্রতিবেদক। শুরুতেই স্থানীয় লোকজন সাবধান করেন, সাংবাদিক এসেছেন জানতে পারলে ‘গোলন্দাজ বাহিনী’র হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। রাতে কোনোভাবেই গফরগাঁওয়ে না থাকার পরামর্শও দেন তাঁরা। অগত্যা ময়মনসিংহ থেকে গফরগাঁওয়ে যাতায়াত করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। দিনে গিয়ে উপজেলার রসুলপুর, বারবাড়িয়া, সালটিয়া ও যশরা ইউনিয়নে সাংসদের অনুসারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার নয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে তাঁদের আবার নির্যাতন করা হবে। একটি পরিবারের সদস্যরা জানান, একবার তাঁরা একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। পরে অস্ত্রের মুখে ‘তাঁদের সঙ্গে কিছু হয়নি’—এমন লিখিত বক্তব্য দিতে বাধ্য করেন সাংসদের অনুসারীরা।

নির্যাতনের শিকার গফরগাঁও পৌরসভার সাবেক মেয়র ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী কায়সার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আর দেশে কোথাও আছে বলে মনে হয় না। নুন থেকে চুন খসলেই পিটিয়ে এলাকাছাড়া করা হচ্ছে। সরকারি যেসব উন্নয়ন প্রকল্প আসছে, সেগুলোর যথাযথ কাজ হচ্ছে না। সাংসদের লোকজন ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন। কায়সার আহমেদ বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আমাদের দলের সাংসদের সঙ্গে বিএনপির লোকজনও রাজনীতি করতে পারেন। কিন্তু দলীয় লোকজন অত্যাচারিত হয়ে এলাকাছাড়া হচ্ছেন।’

এলাকাছাড়া হয়ে এখন ময়মনসিংহ শহরে থাকেন উপজেলার বারবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান জাহিদ হোসেন। তিনি উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদকও। প্রথম আলোকে জাহিদ জানান, ২০১৬ সালের সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু সাংসদ তাঁকে বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে দলের মনোনয়ন পাইয়ে দেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে পরাজিত হন। সাংসদের অনুসারীরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হত্যার ভয় দেখানো শুরু করেন। পরিবার নিয়ে এলাকা ছাড়েন। এখন পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জায়গাজমি বিক্রি করে শহরে সংসার চালান তিনি।

একই অবস্থা রসুলপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মইনুল হকের। মনোনয়ন না পেয়ে তিনিও স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, সাংসদের অনুসারীরা জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল করে তাঁকে পরাজিত করেন। তাঁর লোকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দেওয়া হয়। বাড়িতে হামলা হয়। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন।

উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ফরহাদ ও ছাত্রলীগের রাউনা ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শাওন হাসনাত সাবেক সাংসদ গিয়াস উদ্দিন আহমেদের অনুসারী। ফরহাদকে ২০১৫ সালে মারধর করেন গোলন্দাজের অনুসারীরা। এরপর বাবা-মা, ভাইবোনসহ ১৫ সদস্যের পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ফরহাদ বলেন, ‘চাচার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য একবার বাড়ি গিয়েছিলাম। সাংসদের অনুসারীরা বাড়ি ঘেরাও করলে কোনোরকমে পালিয়ে চলে আসি।’ শাওনের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি।

এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোক অভিযোগ করেন, ফাহমি গোলন্দাজ সাংসদ হওয়ার পর থেকে তাঁর অনুসারীরা বিভিন্ন সময় এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালিয়েছেন। সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর রাতে যশরা বিহারি মোড় বাজারে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওবায়দুল আনোয়ারের সঙ্গে রাজনীতি করেন বলে গোলন্দাজের অনুসারী উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান এবং মাহমুদুল হাসান ওরফে জায়েদের নেতৃত্বে একদল লোক ১০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এ সময় বাজারসংলগ্ন আরও ৫-৬টি বসতবাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

যশরা ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তিনটি দোকানের সব কটি ভাঙচুর করা হয়। মো. মুস্তাকিন নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, বাজারে তাঁর মুদিদোকান ছিল। ওপরের টিনের চাল ছাড়া বাকি সবকিছু ভেঙে অনেক মালপত্র নিয়ে যায় হামলাকারীরা। তাঁদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। এ সময় তাঁর নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা বোনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাহমুদ হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নিজেকে ফাহমি গোলন্দাজের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর দাবি, সেদিন ওবায়দুল আনোয়ারের লোকজন হামলা করেছিলেন। বাজারে তাঁর দোকানও ভাঙচুর করা হয়। তিনি গফরগাঁও থানায় মামলা করেছেন। আতাউর রহমান বলেন, তাঁর নেতা ফাহমি গোলন্দাজ কখনো হামলা বা ভাঙচুরের শিক্ষা দেননি। তাই এসব করার প্রশ্নই ওঠে না।

জানতে চাইলে ওবায়দুল আনোয়ার বলেন, পাঁচ বছর ধরে সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজ গফরগাঁওয়ে যে অত্যাচার, নির্যাতন ও দুর্নীতি করেছেন, তা থেকে দলের মানুষ এখন মুক্তি চায়। স্থানীয় পুলিশও সাংসদ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে মারধর ও বাড়িঘর ভাঙচুরের পর মামলা করতে চাইলেও পুলিশ নেয়নি। উল্টো তাঁর (ওবায়দুল) লোকজনের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। কর্মীদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুরের ছবি তিনি ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারকে (এসপি) দিয়েছেন। এসপি বিষয়টি দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন।

ভুক্তভোগীদের মামলা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গফরগাঁওয়ের দায়িত্বে থাকা ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক হলো কাজে যোগ দিয়েছি। মামলা করতে এসে মামলা করতে পারেনি এরকম কোনো তথ্য জানা নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে থানা মামলা নেবে।’

নিজ দলের লোকজনের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজের সঙ্গে কথা বললে অভিযোগকারী ব্যক্তিদের নাম জানতে চান তিনি। এলাকাছাড়া কয়েকজনের নাম বললে তিনি প্রথমে দাবি করেন, ‘এরা সবাই এলাকায় আছে। কিন্তু আমাকে হেয় করার জন্য বাইরে আছে বলে দাবি করছে।’ প্রায় ২১ মিনিটের আলাপে সাংসদ ফাহমি একপর্যায়ে বলেন, এদের ছেলেমেয়েরা ময়মনসিংহে লেখাপড়া করে বলে তারা সেখানে থাকে।

একে একে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের তথ্য জানানো হলে সাংসদ একপর্যায়ে বলেন, ‘প্রথম আলোর কাজ হচ্ছে সব সময় আওয়ামী লীগের যারা জনপ্রিয় এমপি আছে, তাদের বিরুদ্ধে নিউজ করে বিতর্কিত করা।’ এলাকার দলীয় লোকজনই তো আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো করেছেন—এ কথা বললে সাংসদের গলা চড়ে যায়। তিনি বলতে থাকেন, ‘যারা জনপ্রিয় ব্যক্তি আছে, তাদের বিরুদ্ধে লিখে আপনারা নির্বাচনের আগে বিতর্কিত করেন। আমি যদি সেই মিশনে পড়ি, তাহলে তো আপনি আপনার কথাই লিখবেন। আমার পক্ষে লিখবেন না।’

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল হক গফরগাঁওয়ের বিষয়ে কোনো কথাই বলতে রাজি হননি। তবে গফরগাঁও এবং ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ ফাহমি গোলন্দাজ ও তাঁর অনুসারীদের অত্যাচারে দলের লোকজন যে এলাকাছাড়া, তা কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জানানো হয়েছে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিজবাহউদ্দিন সিরাজের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদের কারণে দলীয় লোকজনের এলাকাছাড়ার বিষয়টি আমরা জানি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে।’ সাংসদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না, বা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সবার নজরেই আছে।’