'নব্য জেএমবি'র অর্থদাতা নিয়ে দুই রকম তথ্য র্যা ব ও পুলিশের

জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’র অর্থ বিতরণের দায়িত্বে কে ছিলেন, তা নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যা ব ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বলছে, গুলশান হামলায় জড়িত ‘নব্য জেএমবি’র অর্থ বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন তানভীর কাদেরী। যিনি গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে পুলিশের অভিযানের সময় নিহত হন। আর র্যা ব বলছে, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে নব্য জেএমবির সব টাকাপয়সা বিতরণ করতেন ‘আবদুর রহমান’। ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় র্যা বের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে মারা গেছেন কথিত এই আবদুর রহমান। তবে তাঁর প্রকৃত নাম-পরিচয় এখন পর্যন্ত উদঘাটন করা যায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে পুরোনো জেএমবির সাতজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনে ও এর পরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে জঙ্গি মামলাগুলোর তদন্তের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন ও প্রশ্নের জবাব দেন।
গুলশান হলি আর্টিজানে হামলায় অর্থ জোগানদাতাদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জি, করতে পেরেছি। এটা ডা. রোকন (খন্দকার রোকন উদ্দীন) যে সিরিয়ায় চলে গেছে, সে ৮০ লাখ টাকা দান করে গেছে। তারপর মেজর জাহিদ তার রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটসহ (অবসর নেওয়ার পর প্রাপ্ত অর্থ) যা কিছু পেয়েছে তা এই জঙ্গি সংগঠনে দান করে গেছে। তারপর তানভীর কাদেরী তার উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রিসহ তার যা সঞ্চয় ছিল, সেসব দান করে গেছে। এগুলো থেকে এবং তাদের বিদেশে থাকা সদস্যের কাছ থেকেও অর্থ এসেছে।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থ জোগানদাতারা অর্থ দিয়েছে আর অর্থসচিব তা বিতরণ করেছে। অর্থসচিবের দায়িত্ব ছিল তানভীর কাদেরীর।’ তিনি এও বলেন, ‘আমরা সবাইকে চিহ্নিত করতে পারি নাই। যতটুকু করতে পেরেছি ততটুকু বললাম। প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। হয়তো আরও অর্থদাতা এই নব্য জেএমবির থাকতে পারে।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মনিরুল ইসলামকে র্যা বের অভিযানের সময় নিহত আবদুর রহমানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যাকে নব্য জেএমবির সাম্প্রতিক সব হামলার অর্থ জোগানদাতা হিসেবে দাবি করে আসছে র্যা ব। প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, ‘আবদুর রহমানসংক্রান্ত তথ্য আমাদের কাছে নেই। যেহেতু তার প্রকৃত নাম আবদুর রহমান না, সেহেতু প্রকৃত নাম জানা গেলে তার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিলে জানা যেতে পারে।’
এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, সেটা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পুরো ঘটনার বিষয়ে তাঁরা কিছুটা জানতে পেরেছেন। অর্থ এসেছে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে। প্রায় ১৪ লাখ টাকা এসেছে একবারে। এ টাকা জঙ্গিরা অস্ত্র সংগ্রহ ও বাসাভাড়ার কাজে লাগিয়েছে। এই অর্থটা যিনি গ্রহণ করেছেন, তাঁর পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে বিদেশ থেকে কে অর্থ পাঠিয়েছে, তা জানতে পারেনি পুলিশ।
তখন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে আসা এই ১৪ লাখ টাকা গ্রহণ করেছিলেন বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট নামের নব্য জেএমবির এক সদস্য। এই বাশারুজ্জামান এখনো ধরা পড়েননি।
এদিকে র্যা ব বলছে, আশুলিয়ায় নিহত কথিত সেই আবদুর রহমানই নব্য জেএমবির অর্থের জোগানদাতা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে বলা যায় আবদুর রহমানই মূলত টাকাগুলো বিভিন্ন জায়গায় দিত। তবে এ টাকা কোত্থেকে আসত, কীভাবে আসত তা এখনো জানা যায়নি।’
গুলশান হামলায় আবদুর রহমান টাকা দিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘এটা নিশ্চিত না। তবে নব্য জেএমবি যে হয়েছে এর প্রশিক্ষণ, বাসাভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচের টাকাই আবদুর রহমান দিত। এ বিষয়ে র্যা বের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রমাণাদি রয়েছে।’
র্যা বের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮ অক্টোবর আশুলিয়ার ওই বাড়িতে র্যা ব অভিযান চালাতে গেলে টের পেয়ে গৃহকর্তা গ্রিল কেটে পঞ্চম তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। ওই বাসা থেকে তিন শিশুসন্তানসহ মারা যাওয়া ব্যক্তির সন্তানসম্ভবা স্ত্রী শাহনাজ আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ৩০ লাখ টাকা। সেদিন ওই বাড়িতে পাওয়া পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও অন্যান্য পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে র্যা ব মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম বলেছিল আবদুর রহমান।
পরে খোঁজখবর করে র্যা বের কর্মকর্তারা জানান, ওই বাসা থেকে যে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জন্মনিবন্ধন সনদ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো ভুয়া পরিচয় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। গতকাল র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মারা যাওয়া ব্যক্তির স্ত্রী শাহনাজ আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাঁর স্বামীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এর আগে গত ৯ অক্টোবর র্যা বের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ওই ব্যক্তি বেঁচে ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি লোকটি জেএমবির অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করত। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে এবং দেশের ভেতর থেকেও টাকা তুলত।’
জঙ্গিদের তহবিলেও নয়ছয়: ঢাকার খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা চিকিৎসক খন্দকার রোকন উদ্দীন, তাঁর স্ত্রী কলেজশিক্ষক নাঈমা আক্তার, তাঁদের দুই মেয়ে ও বড় মেয়ের জামাতা এক বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে পরিবারটি সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন আইএসনিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে গেছে। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে ডা. রোকন নব্য জেএমবিকে দেওয়ার জন্য যে টাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, তাঁর স্বজনেরা সে টাকার কিছু নয়ছয় করেছেন।
এ বিষয়ে গতকাল মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডা. রোকন যাওয়ার আগে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা রেখে গিয়েছিল। বলে গিয়েছিল এই এই নামে লোক আসলে টাকা দিয়ো। এই টাকার কিছু অংশও মিসিং হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘রোকন আইএসের শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছে। সম্ভবত রাকার (আইএসনিয়ন্ত্রিত এলাকা) দিকে সে অবস্থান করছে। সিরিয়া থেকে তার যোগাযোগ এখনো থাকতে পারে।’