আওয়ামী লীগে একক নিয়ন্ত্রণ, বিএনপিতে বিরোধ

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য

২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর এককাট্টাই ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু ২০২২ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুজনের দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর সময় যত গেছে, শীর্ষ দুই নেতার বিরোধ ততই বেড়েছে। এরই মধ্যে সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের মৃত্যুতে পাল্টে যায় জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতির চিত্র। এখন সভাপতির হাতেই দলের নিয়ন্ত্রণ।

অন্যদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি এখন দুই পক্ষের কোন্দলে বিপর্যস্ত। সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকে দুই পক্ষ দলীয় কর্মসূচিও পালন করছে পৃথকভাবে। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা।

১১ মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি আ.লীগের

জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আট বছর পর গত বছরের ১২ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কমিটিতে সভাপতি হিসেবে আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আল মামুন সরকারের নাম ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে হেলাল উদ্দিন, সহসভাপতি হিসেবে মো. হেলাল উদ্দিন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুবুল বারী চৌধুরীর নাম ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে আলোচনা করে এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দুই শীর্ষ নেতার দ্বন্দ্বের কারণেই দীর্ঘ প্রায় ১১ মাসেও জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।

আল মামুন সরকার ২ অক্টোবর সকালে মারা যান। তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা দেন সভাপতি মোকতাদির চৌধুরী। মাহবুবুল বারী সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

হাফিজুর রহমান মোল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে মাহবুবুল বারী চৌধুরীর নাম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে সুপারিশ করতে পারেন মোকতাদির চৌধুরী। কিন্তু তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিতে পারেন না। এটির এখতিয়ার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা সভাপতি প্রাথমিকভাবে কাজ করার জন্য মাহবুবুল বারী চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আপাতত কাজ করুক। দলের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের চারজন নেতা বলেন, মূলত জেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই প্রয়াত আল মামুন সরকারের সঙ্গে মোকতাদির চৌধুরীর বিরোধ বাড়তে থাকে। এরপর সম্মেলন ও কমিটি গঠন থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে তাঁদের বিরোধ বেড়েছে। আল মামুন সরকার একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। রাগ-অভিমানে দলীয় অনেক সভা-অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। তবে জেলা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় দলের সভাপতি মোকতাদির চৌধুরীর নির্দেশনাতেই।

জেলা আওয়ামী লীগে আলোচনা রয়েছে, সম্মেলনের পর সভাপতি ও সদ্য প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রের কাছে পৃথক পৃথক পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছিলেন। যে কারণেই আটকে যায় কমিটি। তবে পৃথক কমিটি জমা দেওয়ার তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন মোকতাদির চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছে কোনো কমিটি জমা দিইনি। যদি কেউ এটা বলে থাকেন, মিথ্যাচার করেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আর সবাই জানেন মিথ্যাচার ও প্রতারণা করি না।’ তিনি দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী আল মামুন সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মোকতাদির চৌধুরী সঙ্গে বসে কমিটি করতে। অনেক কিছু নিয়ে বসা হলেও কমিটি নিয়ে বসা হয়নি। নানান কারণে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই না বিরোধ ছিল।

জেলা আওয়ামী লীগের চার সদস্যের কমিটির পাশাপাশি সদর, বিজয়নগর ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি রয়েছে। অন্য উপজেলাগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নয়টি উপজেলা নিয়ে ছয়টি সংসদীয় আসন। এর মধ্যে পাঁচটিতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন। প্রতিটি আসনেই দলের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় তৃণমূলেও কোন্দল বাড়ছে বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোরও হালনাগাদ কমিটি নেই। জেলা যুবলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯ বছর আগে। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৯ বছর আগে, জেলা যুব মহিলা লীগের ৯ বছর আগে, জেলা মহিলা লীগের ৭ বছর আগে ও জেলা কৃষক লীগের ৬ বছর আগে সম্মেলন হয়েছিল। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় ছয় বছর আগে। উপজেলা পর্যায়েও সংগঠনগুলোর অবস্থা একই রকম।

তবে মোকতাদির চৌধুরী বলেন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই ভালো। নির্বাচনের প্রস্তুতিও ভালো। অঙ্গসংগঠনগুলোর সারা দেশে যা অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও তাই।

সিরাজুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সদস্যসচিব

বিএনপিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত

জেলা বিএনপির সাংগঠনিক বিপর্যয় শুরু মূলত ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। সর্বশেষ জেলা বিএনপির পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দেয়। পাঁচ সদস্যের কমিটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে দলের প্রায় সব কর্মসূচি হচ্ছে পৃথকভাবে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ আগস্ট ঘোষিত কমিটিতে জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি আবদুল মান্নানকে আহ্বায়ক এবং জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলামকে সদস্যসচিব করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আগের কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য হাফিজুর রহমান মোল্লা, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আগের কমিটির সদস্য জহিরুল হক এবং সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকীকে সদস্য করা হয়।

বর্তমানে এই কমিটির আবদুল মান্নান ও সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি পক্ষ এবং  হাফিজুর রহমান ও জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে আরেক পক্ষ পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন। কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভও হচ্ছে। গত ১২ আগস্ট শহরের পাওয়ার হাউস রোড এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

কিন্তু বিএনপির নেতা হাফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, বিগত দিনে জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে যাঁরা নির্বাচনে করেছেন, তাঁরা এই জেলার অভিভাবক। তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

এদিকে বিএনপির একটি পক্ষের নেতাদের অভিযোগ, জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পেছনে রয়েছেন সদর উপজেলার বরিশল গ্রামের কবির আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমানের বড় ভাই। কোনো পদে না থেকেও ছোট ভাইয়ের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে জেলার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনে হস্তক্ষেপ করেন। এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে নানা সময় বিক্ষোভ, ঝাড়ুমিছিলের ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন কমিটি থেকে বিএনপি ও যুবদলের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী পদত্যাগও করেছেন।

বিএনপি নির্বাচনে গেলে কবির ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। কবিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই বিএনপির মহাসচিব, ২০২২ সালের ২ এপ্রিল ও ১৫ নভেম্বর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আখাউড়ার বিএনপির তিন নেতা অভিযোগ করেন।

তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় কবির আহমেদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালে তিনি দেশের বাইরে থাকার কথা উল্লেখ করে দেশে এসে কথা বলবেন বলে জবাব দেন।

নতুন আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একটা বড় দলে মান-অভিমান থাকতেই পারে। এটাই বাস্তবতা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এই কমিটি না মানার অর্থ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে না মানা।

কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, মাঠের বাস্তবতা হয়তো ভিন্ন থাকে। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।