ক্ষোভ থাকলেও বিএনপির অবস্থান এখনো অস্পষ্ট

  • প্রায় এক দশক আগে থেকে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার একটা চেষ্টা ছিল বিএনপির।

  • গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আবার ভারতবিরোধী বক্তব্য–বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। দলটির নেতাদের অনেকে নির্বাচনে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন; তাঁরা সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত–বিরোধিতার রাজনীতিতে বিএনপি আসলে কতটা অগ্রসর হবে, এই প্রশ্নে দলটিতে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।

যদিও বিএনপি এখনো তাদের অবস্থান চূড়ান্ত করেনি। কাল সোমবার দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে বলে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন।

তবে এরই মধ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটি আন্দোলনের বিষয় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২০ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ দেখিয়েছেন। সেদিন তিনি নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন। তাঁর সঙ্গে থাকা এক দল নেতা–কর্মী সেখানে চাদরটি আগুন দিয়ে পোড়ান।

রুহুল কবির রিজভী গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়ে তিনি দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর এমন প্রতিবাদের বিষয়টি দল জানে বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু এই প্রতিবাদ ঘিরে বিএনপিতে নানা আলোচনা চলছে।

বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, রুহুল কবির ব্যক্তিগত আবেগ থেকে, নাকি দলীয় সিদ্ধান্তে ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এটি তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়।

দলটির অন্যতম মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের কাছেও পরিষ্কার নয় বিএনপির অবস্থান। এই জোটের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে ভারতের ভূমিকায় তাঁদের জোটের নেতা–কর্মীদের মধ্যেও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিএনপির নেতাদের অনেকে যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাতে দলটির অবস্থান সম্পর্কে শরিক দল ও জোটগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছিল ভারত। এ নিয়ে বিএনপির পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের অন্য দল ও জোটগুলোতেও ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। কিন্তু বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ভারতকে মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন, সেটা কতটা পরিপক্ব রাজনৈতিক অবস্থান হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ভারত ইস্যুতে দলের অবস্থান কী হবে, এ নিয়ে তাঁদের দলীয় ফোরামে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করেই তাঁরা দলের অবস্থান ঠিক করবেন।

রিজভীর প্রতিবাদ ব্যক্তিগত না দলীয় তা নিয়ে দলে নানা মত। আগামীকাল স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হতে পারে।

এদিকে, রিজভীর প্রতিবাদের ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ২২ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি দেশের বাজারব্যবস্থাকে অস্থির করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বিএনপির ডাকে জনগণ সাড়া দেবে না।’

কেন নেতিবাচক আলোচনা

প্রায় এক দশক আগে থেকে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার একটা চেষ্টা ছিল বিএনপির। দলটির ভোট বর্জনের মুখে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার ও দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের পুরোনো জোট ভেঙে দেয়। দলটির নেতারা ভারত নিয়ে কোনো ইস্যুতে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকেন। এমনকি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ও ভারত প্রশ্নে সতর্ক ছিল বিএনপি; বরং বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত কোনো দলের পক্ষ না নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে ভূমিকা রাখবে, এ ধরনের বক্তব্য বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ভারত আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে আস্থায় নেয়নি বলে দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন। বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাঁদের আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো একটা অবস্থান নেওয়ার পরও ভারতের ভূমিকার কারণে আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারির নির্বাচন করতে পেরেছে। আর এই ধারণা থেকেই বিএনপির নেতা–কর্মীদের অনেকের মাঝে আবার ভারতের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের বড় অংশই ক্ষুব্ধ হয়েছে।

এমন পটভূমিতে এখন আবার ভারতবিরোধী বক্তব্য–বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছেন বিএনপির নেতারা। দলটির সঙ্গী দল ও জোটগুলোর সভা–সমাবেশেও কড়া ভাষায় ভারতের সমালোচনা করা হচ্ছে।

ভিন্ন কৌশল

ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপরতা শুরু করে নুরুল হকের (নূর) নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনকারী নুরুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার নির্বাচনে ভারতের একপক্ষীয় ভূমিকার কারণে তাঁরা দেশটির পণ্য বর্জনের কর্মসূচি শুরু করেন।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, ভারত ইস্যুতে দলের কোনো পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। কিন্তু রুহুল কবির রিজভী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ওই কর্মসূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করার পাশাপাশি চাদর ছুড়ে ফেলার যে ঘটনা ঘটিয়েছেন, দলের কোনো পর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া তিনি এটি করেছেন, তা বিশ্বাস করতে পারছেন না দলটির নেতাদের অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন, এর পেছনে দলের শীর্ষ পর্যায়ের ভিন্ন কোনো কৌশলও থাকতে পারে।