নৌকার বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ‘ডামি’, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী

আওয়ামী লীগ এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বাইরে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ায় ভোটে লড়ছেন নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের অনেকে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে আছেন সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা। দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত সক্রিয় থাকবেন না, শুধু ডামি প্রার্থী হিসেবে কাগজে–কলমে থাকবেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে বলছেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে তাঁরা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

তবে দলীয় নির্দেশে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটতে পারে—এমন আলোচনাও চলছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। পরদিন প্রতীক বরাদ্দের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু। প্রার্থীরা এখনই নানাভাবে জনসংযোগ করছেন। তাই দেখার বিষয়, শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন, ‘ডামি’ হিসেবে থেকে যাবেন, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটে।

রাজনীতিতে এখন ডামি প্রার্থী নিয়ে নানা আলোচনা। অভিধান বলছে, ‘ডামি’ মানে নকল বা প্রতিরূপ। আরেকটি অর্থ বলছে, ‘কোনো ঘটনা ঘটার সময়ে যে ব্যক্তি উপস্থিত থাকে, কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় না; সাক্ষীগোপাল।’ নির্বাচনে এমন সাক্ষীগোপাল বা ডামি প্রার্থীর ঘটনা নতুন নয়। এসব প্রার্থী মূলত মূল প্রার্থীকে নানাভাবে সহায়তা দিতেই কাজ করে থাকেন। যেমন তাঁরা এজেন্ট নিয়োগ করে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে মূল প্রার্থীর দল ভারী করতে পারেন।

২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮ কোটি ১০ লাখের কিছু বেশি। এখন সেটি ১১ কোটি ৯১ লাখ ছাড়িয়েছে। তার মানে গত দেড় দশকে নতুন ভোটার হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল একতরফা। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক আছে। তার মানে নতুন ভোটারদের মনোভাব বা দলীয় সমর্থনের বিষয়টি ঠিক পরিষ্কার নয়। পুরোটা সময় ধরেই ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা বেড়েছে। তাই মনোনয়ন না পেয়েও জয়ের সম্ভাবনায় নেমেছেন ভোটে।

শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনো রকম বাধা দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের সবারই নির্বাচন করার মতো টাকা, কর্মী বাহিনী ও দাপট আছে। তাই মাঠ ছাড়ার কোনো কারণ নেই। বরং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একটি বড় অংশ জয়ী হবে নির্বাচনে। তবে নির্বাচনের পর অন্য কোনো সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দল কাউকে কাউকে প্রত্যাহার করাতে পারে।

আরও পড়ুন

তবে দলের মনোনয়নবঞ্চিত সংসদ সদস্য ও নেতাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকতে পারেন স্বতন্ত্র হয়ে। ফরিদপুর-৪ আসনে পরপর দুবার নৌকার প্রার্থী হেরেছেন স্বতন্ত্রী প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের কাছে। বর্তমান সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এবারও নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র হয়ে নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে। ফরিদপুর-৩ আসনে নৌকার বিপক্ষে নির্বাচনে নেমেছেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। তিনিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ের জন্য লড়ছেন। বরিশাল সদর আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১০ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্তমান সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী দলীয় মনোনয়ন হারিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন। হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে নৌকা চেয়ে পাননি আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন। তিনিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জনসংযোগ করছেন এলাকায়। চাঁদপুর-১ আসনে নৌকার বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মঈনউদ্দিন মঈন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগেরও নেতা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নেতা-কর্মীদের মতামত নিয়েই শেষ পর্যন্ত লড়তে ভোটে নেমেছেন। প্রত্যাহার করে নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। তাই দল থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেবে না বলেই আশা করছেন তিনি।

বরগুনা-১ আসনে স্বতন্ত্রী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মোটেই ডামি নন, বরং মূল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে লড়ার। শেষ পর্যন্ত লড়াই করতেই মাঠে নেমেছেন। এখান থেকে সরে আসার সুযোগ নেই।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৫৯ শতাংশ আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ২ হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এটি রেকর্ড। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে মোট প্রার্থীর মধ্যে ২৫ শতাংশ ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর ২০১৪ সালে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রার্থী ছিল স্বতন্ত্র। আর এবার মোট প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, যার মধ্যে অন্তত ৫৯ শতাংশ প্রার্থী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২৯৮টি আসনে নৌকার প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে ৩০০ আসনে দলটি থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৪৪২ জন। এবার ৭১ জন সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন হারিয়েছেন, যার মধ্যে ৬৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। জেলা ও উপজেলার চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। এসব প্রার্থীর নিজস্ব কর্মী বাহিনী আছে। এলাকায় প্রভাব আছে। তাই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জয়ের হাতছানিও আছে সামনে।

দলনিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে প্রতি নির্বাচনেই জয়ের রেকর্ড আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন একক প্রার্থীরা। বাকি ১৪৭টি আসনের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ১০৪ জন। এর মধ্যে ১৬টি আসন জেতেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনজন সংসদে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে।

গাজীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করে জয়ী হতেই প্রার্থী হয়েছেন।

আরও পড়ুন

দলীয় শাস্তির ভয় নেই

দলীয় প্রতীকে যেকোনো নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকে না। কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁকে বিদ্রোহী বলা হয় এবং দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। অতীতে আওয়ামী লীগকেও বহিষ্কার করতে দেখা গেছে। যদিও আওয়ামী লীগ কখনোই কঠোর শাস্তি দেয়নি; বরং বহিষ্কৃতদের পরে সাধারণ ক্ষমা করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে দলে। আর এবার তো প্রার্থী হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

শাস্তির বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান বুঝতে গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলম বড় উদাহরণ হতে পারেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তিনি একাধিকবার বহিষ্কৃত হয়েও আবার দলে ফিরেছেন। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় মে মাসে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁর প্রার্থিতা যদিও বাতিল হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পান তাঁর মা। এরপর গত অক্টোবরে সাধারণ ক্ষমা করে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় আওয়ামী লীগ।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ২ মাস পর ২০১৯ সালের মার্চে ৫টি ধাপে ৪৯৫টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ১৪০টি উপজেলায় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁদের বিদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মদদ দেওয়ার অভিযোগে মন্ত্রিসভার সদস্যসহ ৬০ জন সংসদ সদস্যের একটি তালিকাও করেছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে শাস্তির কথা ছিল, পরে তা আর হয়নি। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ৯টি ইউনিয়নের ফল স্থগিত করা হয়েছিল। বাকি ৯৯২টির মধ্যে ২৭০ টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ওই সময় স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে করে বিএনপির ৯১ নেতাও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায় স্থানীয় বিভাগের নির্বাচনে অংশ নেওয়া শতাধিক বিদ্রোহী নেতাকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরও স্থানীয় নির্বাচনে অনেকেই বিদ্রোহী হন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মারাও যান কেউ কেউ। এরপর দল শাস্তি দিলেও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর আগেই তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে বলছেন, অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে কেউ কেউ শাস্তির বদলে উল্টো পুরস্কৃত হয়েছেন। পরের নির্বাচনে তিনিই পেয়েছেন দলীয় মনোনয়ন। আর এবার দলীয় প্রধান নিজেই প্রার্থী হতে বলেছেন। তাই দলীয় শাস্তির কোনো ভয় নেই।

আরও পড়ুন