মানবতাবিরোধী অপরাধ: জামায়াতের বিচারে আইনের সংশোধন এখনো হয়নি

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার মতো অপরাধে জড়িত থাকায় সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে ২০১৪ সালে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের কথা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ আইন সংশোধন করা হয়নি।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত একাধিক আইনজীবী মনে করেন, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে কোনো সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধানে সুস্পষ্টতার অভাব রয়েছে। এ জন্য আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দের পাশাপাশি ‘সংগঠন’, আরেকটি ধারায় ‘দায়’ শব্দের পাশাপাশি ‘সংগঠনের দায়’ ও অপর আরেকটি ধারায় ‘অভিযুক্ত ব্যক্তির’ পাশাপাশি ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এসব শব্দ যুক্ত হলে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করা সম্ভব হবে।

লোগোটি জামায়াতে ইসলামীর টুইটার থেকে নেওয়া

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। আর সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয় ২০১৩ সালের আগস্ট। পরের বছর ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তও করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাত ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা।

তখন এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার তৎকালীন সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেছিলেন, জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে একাত্তরের নৃশংসতার জন্য তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য তাদের (জামায়াত ও সহযোগী সংগঠনগুলো) সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও অবলুপ্তি চেয়েছে তদন্ত সংস্থা।

জামায়াতের বিচারের বিষয়টি নিয়ে ২১ অক্টোবর প্রথম আলো কথা বলেছে তদন্ত সংস্থার বর্তমান সমন্বয়ক এম সানাউল হকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের বিষয়ে তদন্ত শেষে ২০১৪ সালে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির (চিফ প্রসিকিউটর) কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এরপর এ বিষয়ে তাঁর আর কোনো মন্তব্য নেই।

অপরাধী সংগঠন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ের পর্যবেক্ষণে, জামায়াতে ইসলামীকে একটি অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, দালিলিক প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধী সংগঠনের মতো কাজ করেছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া অন্তত চারটি রায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তানি সেনাদের ‘সহযোগী বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের পাশাপাশি জামায়াতকেও দায়ী করা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায়ই রয়েছে। আইনের অস্পষ্টতা থাকায় ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা সম্ভব হয়নি।

অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে উদ্যোগ নিতে গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতির প্রতি দাবি জানান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার। সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত ওই সভায় তিনি বলেন, ‘এই শোক দিবসে আমার একটি দাবি প্রধান বিচারপতির কাছে, জামায়াতে ইসলামীর বিচারের জন্য। আপিল বিভাগের রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। তাদের বিচারের জন্য আইনের ছোট একটি সংশোধনী দরকার, কী শাস্তি হবে? সেটি কেন হচ্ছে না?’

বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও সদস্য।

নিবন্ধন নেই

অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরু করা না গেলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে এখন আর তাদের নিবন্ধন নেই। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।

অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গত ৬ মে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করেছে। তারা জামায়াতের হোতা ছিল, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা ছিল। রাজনৈতিক দল হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন যথেষ্ট নয়। এটি সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে এখন পর্যন্ত কয়েকবার সংশোধন হয়েছে। ২০০৯ সালে এ আইনের প্রথম দফার সংশোধনীতে কয়েকটি স্থানে পরিবর্তন এনে মূলত আইনটি হালনাগাদ করা হয়। ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীতে আসামির অনুপস্থিতিতে তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে (প্রথমে ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি, পরে দুটি করা হয়) মামলা স্থানান্তরের বিধান সন্নিবেশিত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের সমান সুযোগের বিধান রেখে ২০১৩ সালে সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয়।

যাত্রা শুরুর পর দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচার কার্যক্রম। ট্রাইব্যুনাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৩টি মামলার রায় এসেছে। এসব মামলায় দণ্ডিত আসামির সংখ্যা ১৪২।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে এ পর্যন্ত জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ নেতাসহ ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। আর আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা খাটা অবস্থায় মারা গেছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তানি হাইকমান্ডসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের বিচার না হওয়াটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে আইনমন্ত্রী বলে আসছেন সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। আইন সংশোধন নিয়ে সরকারের দ্বিধা কেন? এর আগেও আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার না হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।