আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা যাতে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য রাজনৈতিক দল, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই নির্বাচন যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী তালিকায় যাতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, নারীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ থাকে এবং দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যাতে প্রান্তিক মানুষের কথা থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেছেন। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন: রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শিরোনামে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে একশনএইড বাংলাদেশ-এর সুশীল প্রকল্প ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সুশীল প্রকল্পের উদ্যোগে দেশের ৯টি জেলায় সংলাপ শেষে এই জাতীয় গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। জেলার সংলাপগুলোয় স্থানীয় নাগরিকেরা সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে যেসব প্রত্যাশার কথা বলেছেন, বৈঠকের শুরুতে সেগুলো নিয়ে তৈরি করা একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের উইমেন রাইটস লিড মরিয়ম নেছা। একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
নতুন করে সংস্কার কমিশন করবে বিএনপি
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে সংস্কারের যেসব সুপারিশ এসেছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করে বিএনপি। গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে অনেকগুলো সুপারিশ এসেছে, সেগুলো নিয়ে আমরা সমৃদ্ধ হব। আরও অনেক বেশি সংস্কার আমাদের করতে হবে, রিকমেন্ডেশনস (সুপারিশ) নিতে হবে। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে নতুন করে কমিশন গঠন করা হবে। আমরা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব নেব।’
এবারের নির্বাচনে জনগণই পাহারা দেবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা বরং গৌণ হবে। মুখ্য হবে ভোটারদের ভূমিকা
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন থাকবে না, আগামী নির্বাচন সে রকম হতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, সেই লক্ষ্যে বিএনপি ভূমিকা রাখবে। জনগণ বহু বছর পরে স্বাধীনভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এখানে জনগণই পাহারা দেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা বরং গৌণ হবে, মুখ্য হবে ভোটারদের ভূমিকা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বিচারকদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। বিএনপির অঙ্গীকার, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণভার, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা হবে। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন করার আগে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালত থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের ক্লিন (পরিষ্কার) করতে হবে।
সালাহউদ্দিন বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সেখানে যেমন গণতন্ত্র শক্তিশালী আছে, বাংলাদেশেও তেমনই হবে বলে আশা করা যায়। গণমাধ্যমের শতভাগ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্টদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, গোত্র, ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধিত্ব রাখার চেষ্টা করবে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। আর্থিক সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা যায় কি না, সেই চেষ্টাও করবে তাঁর দল।
নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বাতিল চায় জামায়াত
গোলটেবিল বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ছিলেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জামায়াতের সাম্প্রতিক সাক্ষাতে উল্লেখ করা কিছু বিষয় আলোচনায় তুলে ধরেন তিনি।
আবদুল্লাহ তাহের বলেন, জামায়াত প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছে, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যাতে আলোচনায় বসা হয়। সেই আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধি লঙ্ঘন না করার অঙ্গীকার করবে। সেটি টেলিভিশনে প্রচার করা হবে। এরপরও নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা সেই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেবেন।
রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক এবং প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে অবাধ নির্বাচন সম্ভব মন্তব্য করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, সব শ্রেণির ভোটার, এমনকি দুর্গম অঞ্চলের মানুষও যাতে ভোট দিতে পারেন। সবাই যেন পূর্ণভাবে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই আয়োজনটা সরকার করবে, সেটাই দাবি। সুষ্ঠু নির্বাচনে যারাই জিতবে, জামায়াত তাদের গলায় মালা দেবে।
জামায়াত প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছে,...নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে সেই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেবেন
গত ৫৪ বছরে দেশের ব্যর্থতার পেছনে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়াটাকে একটা বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন জামায়াত নেতা তাহের। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হবে। নির্বাচনের আচরণবিধি সব দলকে মানতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব অঙ্গীকার শুধু নয়, নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজেদের ভেতরে পরিবর্তন আনতে হবে।
বেশি জরুরি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: এনসিপি
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ক্ষমতার হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হওয়াটা বেশি জরুরি বিষয়। এখন এ জায়গাতেই সবচেয়ে বড় সংকট। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে ফাংশন (কাজ) করলেই অনেক আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়া যেত।
নারী ভোটার ও প্রার্থীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনে আমরা অনেক দিন এটা নিয়ে বিতর্ক করেছি। শেষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবেন। কিন্তু সেটা ক্লাস্টার করে হবে, নাকি ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে হবে—এই পদ্ধতির বেড়াজালে গিয়ে আমরা এত সুন্দর একটা প্রস্তাবকে বাস্তবায়ন করতে পারিনি।’ এনসিপি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ক্ষমতা হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হওয়াটা বেশি জরুরি বিষয়। এখন এ জায়গাতেই সবথেকে বড় সংকট
নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য ও অর্থের বিনিময়ে ভোটের সংস্কৃতি আছে উল্লেখ করে আখতার হোসেন বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন এসেছে। যদিও নির্বাচনে অর্থের ছড়াছড়ি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নারীরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে সর্বস্তরে আস্থার সংকট আছে বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে।
নির্বাচনে নারীদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকলে দেশের নারীরা এগিয়ে যেতে পারবেন না, মন্তব্য করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘মানি (অর্থ), মাসল পাওয়ারের (পেশিশক্তি) যে প্রভাব বিগত সব নির্বাচনে কমবেশি দেখা গেছে, সেখানে নারী প্রান্তিক হয়ে যাবে।’
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নারীরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে সর্বস্তরে আস্থার সংকট আছে
নির্বাচনকালে নানা শঙ্কার কথা তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, একটা হচ্ছে সুষ্ঠু, আরেকটা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক, আরেকটা হচ্ছে যে সহিংসতা। নারীর বিষয়ে আরেকটি উদ্বেগের জায়গা উঠে আসে নির্বাচন-পূর্ব এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জায়গা। সে জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি থাকা জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নানা দাবি-প্রত্যাশা
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের অনেকেই আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের বিভিন্ন দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের সংগঠক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ভবিষ্যতে যাঁরাই ক্ষমতায় আসুন, তাঁরা যেন শুধু পুরুষ, একটা গোষ্ঠী বা ধর্মের নেতা না হয়ে সবার নেতা হন। সবচেয়ে প্রান্তিক ও দুর্বল অবস্থানে যাঁরা আছেন, তাঁদের চাহিদাগুলো আগে পূরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, সংখ্যাগত কারণে কোনো আদিবাসীর পক্ষে নির্বাচনে জিতে আসা সম্ভব নয়। তাই তিনি সংসদে সংরক্ষিত আসনের পক্ষে। আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে যেন আদিবাসী মানুষের অধিকার, তাঁদের বহুমাত্রিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ভূমির অধিকার, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বিকশিত করা—এ রকম অঙ্গীকার থাকে, সেটিও প্রত্যাশা করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম নির্বাচন কমিশনের প্রতি প্রত্যাশা রাখেন, সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে যেন নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের তথ্য ও সেগুলোতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তা জনগণকে জানায়।
নিজের দলে নারীদের সুযোগ করে দিতে গিয়ে ‘বুলিং ও বাজে মন্তব্যে’র শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নির্বাচনে ও রাষ্ট্রে সব শ্রেণি-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ইনক্লুসিভ বলতে বোঝায়, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না। কিন্তু এটা কেউ বলে না যে গ্রামের একজন স্কুলশিক্ষক নির্বাচন করতে পারবেন কি না।
গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে শ্রমজীবী ও নারীদের সংখ্যা মনে করা হয়। মাঠের লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই নারীদের জায়গা তৈরি করতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর নারীদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেভাবে যুক্ত করা হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত। আগামী নির্বাচনে নেতা-কর্মীদের সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে আগাম প্রস্তুতি রাখে, সেই প্রত্যাশা রাখেন তিনি।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবিরের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বৈঠক শেষ হয়। তিনি বলেন, সবাইকে কমন ইন্টারেস্টে (অভিন্ন স্বার্থ) কাজ করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা থাকবেন, তাঁরা যেন ভুলে না যান যে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।