পুরো আসনের ভোটের ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা পাচ্ছে না ইসি

সংসদ নির্বাচনের কোনো আসনে যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, শুধু সেগুলোতে ভোট স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা পাচ্ছে ইসি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
ফাইল ছবি

জাতীয় সংসদের কোনো আসনের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা পাচ্ছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) কেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা পাচ্ছে ইসি। কিন্তু তারা কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা চেয়েছিল।

ইসিকে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা না দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি অনুমোদনের পর এখন তা জাতীয় সংসদে বিল আকারে তোলা হবে। জাতীয় সংসদে পাস হলে এটি আইনের অংশ হবে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এই সংশোধনী আনা হচ্ছে। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, এতে ইসির ক্ষমতায় কোনো হেরফের হচ্ছে কি না—সে প্রশ্নে আরও আলোচনা করা প্রয়োজন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করে গত বছর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। গত ২৮ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে আরপিওর সংশোধনের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, খসড়ায় আরও কিছু সংশোধন, মতামতসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবারও মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। পরে খসড়া আবারও কিছুটা সংশোধন করে গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।’ তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর ইসি ওই ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারে কি না, তা নিয়ে মতদ্বৈধতা আছে।

ইসি ও মন্ত্রিসভা সূত্র জানায়, বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল ইসি। তারা প্রস্তাবে বলেছিল, কোনো অনিয়ম, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো কেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করতে পারবে।

একটি বা পাঁচটি ভোটকেন্দ্রের কারণে পুরো আসনের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা অগণতান্ত্রিক। এটি আইনের নীতিবহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থী বলে এটা গ্রহণ করা হয়নি।
আনিসুল হক আইনমন্ত্রী

গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই বিধান নিয়ে আলোচনা হয়। গত বছরের অক্টোবরে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনায় আসে। বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা দেখে পুরো আসনের ভোটই বন্ধ করে দিয়েছিল ইসি। তখন ইসির এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সরকারি দলের নেতাদের কেউ কেউ। মন্ত্রিসভার বৈঠকে থাকা একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত রাখা এবং পুরো আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়ার বিপক্ষে মত দেন মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ইসি একটি ‘জেনারেল পাওয়ার’ চেয়েছিল। একটি বা পাঁচটি ভোটকেন্দ্রের কারণে পুরো আসনের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা অগণতান্ত্রিক। এটি আইনের নীতিবহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থী বলে এটা গ্রহণ করা হয়নি।

ইসির একটি সূত্র জানায়, নতুন এই বিধান যুক্ত হওয়ার পর যদি এমন হয় যে একটি আসনের পাঁচটি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, তাহলে শুধু ওই পাঁচটি আসনের ফল স্থগিত রেখে তদন্ত করে ফলাফল বাতিল করা যাবে। পুরো আসনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না। আর যদি এমন হয়, ওই পাঁচটি কেন্দ্রের মোট ভোট ১০ হাজার। বাকি কেন্দ্রগুলোতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের বেশি, অর্থাৎ ১০ হাজার ভোটের সব পেলেও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জয়ী হওয়ার সুযোগ নেই, সে ক্ষেত্রে ওই সব ভোটকেন্দ্রে আর নতুন করে ভোট করা হবে না। আর যদি ব্যবধান ১০ হাজারের কম হয় তাহলে সেসব কেন্দ্রে ফলাফল বাতিল করে আবার ভোট নেওয়া হবে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। পরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনের খসড়ার বিষয়ে জানাতে গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পেশিশক্তি বন্ধ করার জন্য বা যেকোনো কারণে নির্বাচন চলাকালে যেকোনো মুহূর্তে এক বা একাধিক ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করা যাবে।

কিন্তু গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে পুরো আসনের নির্বাচন ইসি যে বাতিল করেছিল, সে বিষয়ে সাংবাদিকেরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাতে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, তিনি মন্ত্রিসভার আলোচনার বিষয় নিয়েই থাকতে চান। তাতে যে বিধানগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো নিয়েই থাকতে চান। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবগুলোই পর্যালোচনা করে মন্ত্রিসভা যে বিষয়গুলো যৌক্তিক বলে মনে করেছে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়ক হবে বলে মনে করেছে, সেগুলোই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন কোনো নির্বাচন চলাকালে বা তাদের যদি মনে হয় কোনো কেন্দ্রের নির্বাচনে সমস্যা হচ্ছে, তখন তারা ওই কেন্দ্রের, সেটি এক বা একাধিক হলে তা বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে। কেন্দ্রের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে এক বা একাধিক। এখানে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ব্যাপারে বলা হয়নি। এক বা একাধিক কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিলের সিদ্ধান্ত ভোট চলাকালে বা ভোট গণনার সময় দ্রুত তদন্ত করে হতে পারে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

মনোনয়ন গ্রহণের বিষয়েও আপিল করা যাবে

বিদ্যমান আইনে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তা কারও মনোনয়নপত্র বাতিল করলে তাঁর বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আরপিওর যে খসড়াটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হলেও সে বিষয়ে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হলো, কিন্তু কেউ মনে করলেন সেটি সঠিক হয়নি, তখন চাইলে সে বিষয়ে আপিল করা যাবে।

এত দিন প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগে ব্যাংকঋণ ও বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধের অনুলিপি জমা দিতে হতো। না হলে মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গণ্য হতো। আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনীতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত এসব জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সঙ্গে টিআইএন সনদ এবং কত টাকা আয়কর জমা দেওয়া হয়েছে, তার রসিদ জমা দিতে হবে। আগে এগুলো ছিল না।

প্রস্তাবিত আরপিও সংশোধনীতে গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে বিষয়গুলো (নারী নেতৃত্বসহ) পূরণের সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের এই উদ্যোগের ব্যাপারে বিরোধী দল বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি।

নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এই সংগঠনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে বলা হয়েছিল, ভোট গ্রহণের সময় কারচুপি এবং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সেই অভিযোগ তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন যদি এর সত্যতা পায়, তখন সেখানে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নির্বাচন কমিশন নতুন নির্বাচন দেবে। ২০০০ সালে প্রকাশিত আদালতের এই রায় ছিল নারায়ণগঞ্জের একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে। আদালতের এই রায় অন্যান্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।

বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা না থাকলে আদালতের ওই রায়ের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ হবে না।