জুলাই সনদে সই না করা অংশের দায় নেব না: মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরফাইল ছবি

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের কথা খুব পরিষ্কার, আমরা যেটা সই (জুলাই জাতীয় সনদ) করেছি...আমরা সেটার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করব। কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি, সেটার দায়দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করব না। আমরা চাই, এই বিষয়গুলো একটু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হোক।’

গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন মির্জা ফখরুল। বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস (৭ নভেম্বর) উপলক্ষে এই সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ মঞ্চের ব্যানারে লেখা ছিল ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’।

সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনাদের মনে আছে পার্লামেন্টের সামনে বৃষ্টিতে ছাতা ধরে পাস করেছি, সই (জুলাই সনদ) করেছি না? ওইখানে আমরা যে বিষয়গুলোতে সই করেছি, সেখানে বলা হয়েছিল, যেসব রাজনৈতিক দল যেগুলোতে একমত, সেগুলো সব সই হয়ে গেল। এমনকি যে বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে না, তারা আপত্তি দেবে, সেটাকে বলা হয় নোট অব ডিসেন্ট; সেই নোট ডিসেন্ট লিপিবদ্ধ করা হবে এবং সেটা সনদে লেখা হবে, সঙ্গে সঙ্গে লেখা হবে। আর এখন ওনারা যেটা প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে, সেখানে ওই নোটের কোনো কথাই নাই; আমাদের এই কথাগুলো বেমালুম ভুলে গেছে। তারা আবার নতুন করে কিছু বিষয় নিয়ে এসেছেন। এটা অন্যায়, এটা জনগণের সঙ্গে একটা নিঃসন্দেহ প্রতারণামূলক কাজ।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হতে হবে। পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) হবে কি হবে না, সেটা আগামী সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, গণভোটের প্রয়োজন ছিল না, তারপরও বিএনপি রাজি হয়েছে। তবে নির্বাচনের দিনই গণভোট করতে হবে।

একটি দল মিথ্যা কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে বলেও সমাবেশে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘কোনো একটা দল বলছে, বিএনপি নাকি নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন পেছানোর কথা আপনারাই বলছেন। আরে, বিএনপি তো নির্বাচনমুখী দল। আমরা তো গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাচনের কথা বলে আসছি। আমরা তো নির্বাচন পেছানোর কথা একবারও বলিনি। আমরা বারবার বলেছি যে নির্বাচনটা অতি দ্রুত করতে হবে। আমি বলব, এসব মিথ্যা কথা বলে জনগণকে প্রতারণা করবেন না, মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।’

‘ওরা একাত্তরকে ভুলিয়ে দিতে চায়’

কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, যারা একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারা এখন একাত্তরকে নিচে নামিয়ে দিতে চায়, তারা শুধু চব্বিশের জুলাইয়ের যে আন্দোলন, তাকে বড় করে দেখাতে চায়। তিনি বলেন, ‘খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, ১৯৭১ সালকে ভুলিয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, ১৯৭১ সাল হচ্ছে আমাদের জন্মের ঠিকানা।…এটা আমাদের মনে রাখতে হবে সব সময়।’

ভারতের প্রতি আহ্বান

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। একবারের জন্যও তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। উল্টো অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

ভারতের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা ভারত সরকারকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দিন। বাংলাদেশের আইনে বিচারের মুখোমুখি তাঁকে হতে হবে, সেই বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করুন। সব সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করবেন না, বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেবে না।’

জুলাই সনদ ‘যাদের প্রয়োজন’

জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, দেশের জনগণের জুলাই সনদের ‘প্রয়োজন নেই’। জুলাই সনদ হয়তো কিছু কিছু ব্যক্তির, যাঁরা উপদেষ্টা হয়েছেন, যাঁরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বসবাস করতে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়বেন, তাঁদের জন্য হয়তো জুলাই সনদের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি নির্বাচন। নির্বাচনে যাঁরা বিজয়ী হবেন, জনগণের প্রতিনিধি হবেন, তাঁরাই জুলাই সনদকে সমর্থন করবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমার দল বিএনপি জুলাই সনদকে সমর্থন করেছে। আমরাও এটি সমর্থন করতে বাধ্য। কিন্তু এটার মধ্যে এমন এমন জিনিস ঢোকাবেন না, যেটি নিয়ে আগে আলোচনা হয় নাই। ঐকমত্য কমিশনের মিটিংয়ে আলোচনা হয় নাই। সেসব জিনিসও চূড়ান্ত খসড়ার মধ্যে আমাদের দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সনদের আমাদের প্রয়োজন নাই। আমাদের প্রয়োজন একটা পার্লামেন্ট। যে পার্লামেন্ট আগামী দিনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যেই পার্লামেন্ট এই সনদকেও বাস্তবায়িত করবে এবং আগামী দিনে গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে সক্ষম হবে।’

ভারতের উদ্দেশে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশ স্বনির্ভর হোক। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকুক। তিনি অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে কীভাবে বাংলাদেশে নাশকতা করা যায়, সেই ষড়যন্ত্র করছেন।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘কলকাতায় তারা (কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ) অফিস খুলেছে। আমি তাদের একটা পরামর্শ দেব, শুধু কলকাতা নয়, ভারতের প্রত্যেকটা প্রদেশে আপনারা একটা করে অফিস খোলেন। ভারতের কাছ থেকে সনদ নেন। তারপরে ভারতের রাজনীতিতে আপনারা মিশে যান। বাংলাদেশে আপনাদের কোনো প্রয়োজন নাই।’

জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে এই সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন।

সমাবেশ শেষে মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা-কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত মিছিল করেন।