বাজার পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে চিন্তিত আওয়ামী লীগ। নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের প্রভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে এবং তা আরও বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাদের কারও কারও।

যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা নিত্যপণ্যের বাজার সামলাতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরছেন। তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এমনটা মনে করছেন না দলটির নেতাদের অনেকে। তাঁরা মনে করেন কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে।

তবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও সরকার ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বা সরকারের প্রতি অনুগত ব্যক্তিরাই ব্যবসায়ীদের সব সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছেন বা নেতৃত্বে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্ন থাকে। ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে। এ বিষয়কে বাজার অস্থিরতার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখেন অর্থনীতিবিদেরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের দিক থেকে একধরনের শৈথিল্য রয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক বিষয় ছিল। তবে কিছুটা বিলম্বে হলেও ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেছেন, অল্প সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ শিগগিরই কেটে যাবে, এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জবাব কী হবে অথবা তাঁদের কীভাবে আশ্বস্ত করা যাবে, এসব প্রশ্নও রয়েছে দলটির নেতাদের অনেকের মাঝে।

আবার বাজার পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের বিরক্তির সুযোগ নিয়ে আন্দোলনের চেষ্টা করতে পারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি, এ বিষয়টি নিয়েও দলে আলোচনা রয়েছে। অবশ্য নেতাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, রাজনৈতিক দিক থেকে সরকার এখন কোনো চাপে নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

দেশে এখন চালের দাম এক জায়গায় আটকে আছে। এ ছাড়া সবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে টাউন হল বাজারে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আনোয়ার উল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বেতনের হিসাবের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ চার সদস্যের পরিবারের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় অনেক কিছুই বাদ যাচ্ছে। গত শুক্রবার সকালে ওই বাজারে আসা আরও কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও একই মন্তব্য করেন। তাঁদের কথায় সরকারের প্রতি একধরনের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায়।

ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা অবশ্য সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগের বিষয়টি অস্বীকার করেননি। আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ দফার এই সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি করার বিষয় অগ্রাধিকারের তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে। গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে তা বলা হয়। কিন্তু ১ নম্বর অগ্রাধিকার বাস্তবায়নেই সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। কিন্তু আমরা তো সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের আমদানি বাড়ানো, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে।’ তিনি দাবি করেন, সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো মহলের স্বার্থ বিবেচনা করা হচ্ছে না।

বাজার সামলানো যাচ্ছে না কেন

পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে নানা রকম আলোচনা রয়েছে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দুটি জেলার এবং ঢাকায় একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পেছনে তাঁরাও নিজেদের মধ্যে কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করে থাকেন।

প্রথমত, তাঁরা মনে করেন, চালসহ যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলো চাতাল ব্যবসায়ী বা চালকলমালিক বা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে যায়। এর সঙ্গে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় দাম বেড়ে যায়। এটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা রয়েছে।

আরেকটি বড় কারণ, কিছু পণ্যের বাজার একশ্রেণির আমদানিকারকের নিয়ন্ত্রণে। যেমন আমদানিনির্ভর তেল ও চিনির বাজার গুটিকয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া ডলার-সংকট এবং দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাবও রয়েছে বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন। সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী, তাঁদের ভাঙা যাচ্ছে না, এমনটাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের কারও কারও বক্তব্যে।

ব্যবসায়ীদের সব সংগঠনের নেতৃত্বই যখন কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারপরও কেন বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। এই প্রশ্ন দলের ভেতরেও রয়েছে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া বা সিন্ডিকেটের কারসাজির অভিযোগ মানতে রাজি নন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কোনো কারণ নেই। ডলারের দাম বেশি হওয়ায় এবং পণ্যের সরবরাহে ঘাটতির কারণে কিছু পণ্যের দাম বাড়ে। এ ব্যাপারে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিয়েই এগোচ্ছে।

তবে যে যা-ই বলুক না কেন, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দল ও সরকারে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছে।