নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের চাপ আমলে নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী 

সদ্য সমাপ্ত কাতার সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদ নির্বাচন, বিরোধী দলের অংশগ্রহণসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বিকেলে গণভবনে
ছবি: পিএমও

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের চাপ আমলে নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এমন কোনো চাপ নেই, যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে। তিনি মন্তব্য করেন, বিদেশিদের যে চাপই আসুক না কেন, জনগণের স্বার্থে যা করা দরকার, সরকার সেটাই করবে।

গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। 

প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত কাতার সফর নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ, বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ছিল, ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকেরা সম্প্রতি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—দুই দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছেন কি না?

এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন কোনো চাপ নাই, যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার একমাত্র শক্তি জনগণ। আর ওপরে আল্লাহ আছে। বাবার আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় আছে। কাজেই কে কী চাপ দিল না দিল তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। জনগণের স্বার্থে যেটা করার সেটাই করব। জনগণের কল্যাণে যে কাজ করার সেটাই করব।’ 

আরও পড়ুন

পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ রকম বহু চাপ তো ছিল। পদ্মা সেতুর আগে তো কম চাপ দেওয়া হয়নি। কোনো একটা দেশের একেবারে অ্যাম্বাসেডর থেকে শুরু করে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টেলিফোনের ওপর টেলিফোন! কেন?’

প্রধানমন্ত্রী বললেন

■ সংলাপ কার সঙ্গে? ২০১৮ সংলাপের পর বিএনপি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

■ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে অনেক আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা উন্মুখ হয়ে আছে।

■ ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন?

বক্তব্যের একপর্যায়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা ভদ্রলোক একটা ব্যাংকের এমডি। তাকে এমডি পদে রাখতে হবে। এমডি পদের কী মধু তা তো আমি জানি না। আইনে আছে ৬০ বছর। তাঁর হয়ে গেছে ৭০ বছর। তারপরও এমডি পদে থাকতে হবে। এমডি পদে থাকলে হয়তো মানি লন্ডারিং করা যায়। পয়সা বানানো যায়। গরিবের রক্ত চুষে খাওয়া যায়। সেই চাপও কিন্তু সহ্য করেছি। তারপরও নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানিয়ে তাঁদের দেখালাম যে, চাপে আমাদের কিছু আসে যায় না।’ 

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি বলেছে, শেখ হাসিনার অধীনে তাঁরা নির্বাচনে যাবে না। সাংবাদিক এই কথা বলে প্রশ্ন শুরু করার মাঝেই প্রধানমন্ত্রী জবাব দেন, ‘ভালো কথা!’

বিএনপি ছায়া সরকার করবে—এমন আলোচনার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে দল বেশি লাফায়, তাদের দুই নেতাই সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা না পারবে ইলেকশন করতে, না পারবে ক্ষমতায় আসতে। বিএনপি তো তার নিজের গঠনতন্ত্র নিজেরাই ভঙ্গ করছে। তাদের গঠনতন্ত্রে আছে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না। এখন সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেই দলের নেতা বানিয়ে রেখে দিয়েছে। এই দলের কাছে কী আশা করবেন?’

 ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির জোটের ৩০ আসন পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ এর নির্বাচন সব থেকে অবাধ, নিরপেক্ষ হয়েছে। সেই নির্বাচনেই যখন তাদের দুরবস্থা। এখন তো আওয়ামী লীগ অন্তত কাজ করে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। 

বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নয়

নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘সংলাপ কার সাথে করব? ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংলাপ করেছি, তাতে রেজাল্ট কী? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ৩০০ আসনে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে, টাকা খেয়ে নিজেরাই নিজেদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’ 

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, আরাফাত রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে অপমানিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এত কিছুর পর তাদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক? যারা এটুকু ভদ্রতা জানে না, তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে? 

এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ। তাঁর বোন, ভাই, বোনের জামাই—সবাই এসে আমার কাছে, রেহেনার (শেখ রেহেনা) কাছে আকুতি করল। সাজাটা স্থগিত করে বাসায় থাকার ও চিকিৎসার সুযোগটা করে দিয়েছি। এটুকু যে করেছি, সেটাই যথেষ্ট। যারা বারবার আমাদের ওপর হত্যা করে, অপমান করে। এরপরও যে এটুকু সহানুভূতি পাচ্ছে, সেটা তো আমার কারণে। আর কী ক্ষমতা তাদের আছে? সন্ত্রাস করা ছাড়া তো তাদের আর কোনো ক্ষমতা নেই।’ 

৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে বিজ্ঞাপন দিতে হবে কেন?

সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে হয়রানি করা হচ্ছে—এমন কথা উল্লেখ করে একটি খোলাচিঠি ছাপা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন প্রশ্ন করে বলেন, আপনি যখন কাতারে ছিলেন, তখন ৪০ জন বিদেশি নাগরিকের একটি বিবৃতি বা আপিল প্রকাশ হয়েছে, সেটা আপনি পেয়েছেন কি না, জানতে চাই। সেটা ওয়াশিংটন পোস্ট–এ বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। এই বিবৃতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য আশা করছি।

এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা বিবৃতি তো না, এটা একটা বিজ্ঞাপন। যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটা আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে, এটার কী উত্তর দেব জানি না, তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার প্রশ্নটা হলো, যিনি এত নামীদামি, নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত তাঁর জন্য এই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন? তা–ও আবার বিদেশি পত্রিকায়। এটাই আমার প্রশ্ন আর কিছু না। অ্যাড দিতে হলো কেন?’ 

ড. ইউনূসের কাজ করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে যা–ই হোক, দেশে কতগুলো আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী সবকিছু চলবে এবং সেটা চলে। দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। দেশে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। যারা আয়কর ঠিকমতো দেয়, সেটার আলাদা বিভাগ আছে। তারা তা আদায় করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি এখন এই সমস্ত বিষয়ে কোনো রকম আইন ভঙ্গ করে বা শ্রমিকদের কোনো অধিকার কেড়ে নেয়, শ্রম আদালত আছে, সেটা দেখে। এ ক্ষেত্রে আমার তো কোনো কিছু করার নেই সরকারপ্রধান হিসাবে।’

একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু কিন্তু করে ফেলেছি, খালি এইটুকু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।’

‘নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে উন্মুখ হয়ে আছে’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই বলে থাকেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা রয়েছে। সামনে নির্বাচনে সেই চেষ্টা হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনাদের প্রস্তুতি কী? এই প্রশ্ন করেন সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল।

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এজেন্সি উন্মুখ হয়ে আছে। ৪০ জনের নামে (ওয়াশিংটন পোস্ট–এর বিজ্ঞাপন) যেটা এসেছে, ওটার পেছনেও কিছু অ্যাম্বিশন আছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। যাদের ইচ্ছা, তারা জনগণের কাছে যাবে। নির্বাচন যাতে অবাধ-সুষ্ঠু হয়, তার জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংশোধনী বা সংস্কার আনা হয়েছে।’ 

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা করা হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোর যাতে আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্যই সংস্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন জনগণের ওপর নির্ভর করে, জনগণ কীভাবে চায়? জনগণ যেন ভোট দিতে পারে, আমাদের সে প্রস্তুতি সব সময় আছে।’ 

‘একটি ঘাসের ওপর একটি শিশিরবিন্দু’

একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেন, ‘পুরো কাতার ছিল বাংলাদেশময় এবং গোটা সেশনটাই ছিল শেখ হাসিনাময়। আমাদের ইভেন্ট ছাড়াও সাইড ইভেন্টগুলোর প্রতিটাতেই ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের নাম এসেছে। বাংলাদেশ হয়েছে একটা রোড মডেল। আপনি বলতে ভুলে গেছেন যে তিনি বাংলাদেশের স্মার্ট ধারণা থেকে স্মার্ট সোসাইটিকে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’ মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘আলজাজিরার সম্পাদকীয় নীতি উদার ও অসাম্প্রদায়িক সরকারগুলোর পক্ষে নয়। তারপরও গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আপনি তাদেরকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তারা অনেক কয়টা ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন করেছে। তার সমীচীন জবাব আপনি দিয়েছেন। সে জন্য আপনাকে অভিনন্দন।’

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কথা সেটা না। চেষ্টা করেছি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলতে। একসময় বাংলাদেশ শুনলেই মনে করত যে দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা-খরার দেশ। এখন আর সেটা কেউ মনে করে না। এখন বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে করে।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া একটি ঘাসের ওপর একটি শিশিরবিন্দু।” তা আমার অবস্থা সে রকমই।’

রোজায় দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে । আমি বিশ্বাস করি কেউ কিছু করতে পারবে না। হয়তো সাময়িক কিছু একটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেটা মোকাবিলা করবে আমাদের জনগণই। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে যে উন্নয়ন হয়, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি।’

লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা বা দাক্ষিণ্য চায় না। বরং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের ন্যায্য পাওনা চায়। 

সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার এক পাশে বসেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। অন্যপাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।