ক্যাম্পাসকে নেতৃত্ব দিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি

আলতাফ পারভেজফাইল ছবি: প্রথম আলো

বহু বছর কোনো উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন হয় না বাংলাদেশে। উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতেও ছিল অলিখিত নির্বাচনী নিষেধাজ্ঞা। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধি বাছাইয়ের আনন্দমুখর ঐতিহ্যের কথা ভুলেই গেছে ক্যাম্পাসগুলো। ছয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর যে নির্বাচন হয়, সেটাও জালিয়াতি ও বিতর্কের শিকার ছিল। দমবন্ধ ওই অবস্থা থেকে বিদ্যাপীঠগুলোকে মুক্তি দিয়েছে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান।

প্রধান প্রধান ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা আবার প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ পাচ্ছে। ডাকসু, জাকসু এবং রাকসুতে নির্বাচনের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। বহুকাল পর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বাড়তি প্রাণের হিল্লোল এখন।

চব্বিশের আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী ও সংগঠন নেতৃত্ব দিয়েছে, পরিশ্রম করেছে, গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে, এই নির্বাচনী উৎসব তাদের বড় অবদান। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, প্রচারে যেন আনন্দমুখর পরিবেশ বজায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করাও এই শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব হিসেবে থাকবে।

আরও পড়ুন

বহুকাল ডাকসু-জাকসু-ইকসু-রাকসুর নির্বাচন আটকে রাখা হয়েছে এই যুক্তিতে যে এতে শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়, ক্যাম্পাসে সংঘাত বাড়ে। সেই যুক্তিকে অসার ও অসত্য প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ এখন শিক্ষার্থীদের সামনে। তবে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের চর্চায় বিভাগের পড়াশোনা ও হলজীবনকে আনন্দদায়ক করতে গিয়ে যেন সহপাঠীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

পুরো দেশ এখন ডাকসু, জাকসু ও রাকসু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। প্রত্যেক প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দায় থাকবে দেশবাসীকে দেখিয়ে দেওয়া, গণ-অভ্যুত্থান শিক্ষার্থীদের বাড়তি দায়িত্বশীল করেছে।

অতীতে ডাকসুসহ শিক্ষার্থীদের সব পরিষদের ভোটে মেধাবী এবং সাংস্কৃতিকভাবে চৌকসদের বাড়তি কদর থাকত। পাশাপাশি রাজনৈতিক আদর্শবাদ নির্বাচনী প্রচার ও পছন্দকে প্রভাবিত করত। এবারও নিশ্চয়ই সেটা হবে। ইতিমধ্যে ডাকসু-রাকসু-জাকসুতে প্যানেল তৈরি ও মনোনয়নে রাজনৈতিক আদর্শবাদের আলোকে ব্যাপক মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের মেধাবী সমাজের বড় একাংশ। দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে থাকতে থাকতে তারা জেনে যায় কোন সহপাঠীরা প্রতিনিধি হিসেবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করতে সমর্থ এবং কাদের নেতৃত্বশক্তি পরীক্ষিত। এ-ও অজানা থাকে না কারা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন, শিক্ষাবান্ধব ও নৈতিকভাবে সৎ। নির্বাচনী প্রচারে এসব বিবেচনাই অগ্রাধিকার পায় এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।

জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে বাংলাদেশ বর্ণিল এক দেশ। প্রত্যেক ক্যাম্পাসে তার প্রবল ছাপ রয়েছে। বিপুল সংখ্যায় নারী শিক্ষার্থীও রয়েছে সব উচ্চবিদাপীঠে। এ রকম পরিসরে বহুত্ববাদ এবং সমতার সংস্কৃতি একান্ত জরুরি। দেশের সব প্রান্তের অভিভাবকদেরও স্বাভাবিক প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন বহুত্ববাদী উদার পরিবেশ থাকে। তাহলেই কেবল সন্তানকে ক্যাম্পাসে রেখে নিশ্চিত থাকা যায়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্যাম্পাসে অন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শের তরুণ-তরুণীরাই নির্বাচনী উৎসবে এগিয়ে থাকুক, সেটাই জাতীয় প্রত্যাশা।

এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গর্ব করার দিক হলো, তারা একই সঙ্গে সমাজের সন্তান ও ‘অভিভাবক’। যুগের পর যুগ ‘সমাজ’ তার এই সন্তানদের পাঠিয়েছে উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি এই শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করেছে দেশের প্রয়োজনে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণতন্ত্রের সংগ্রাম থেকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিয়েছে। এ দেশের যা কিছু বড় রাষ্ট্রনৈতিক অর্জন, তার বড় অংশীদার বিশ্ববিদ্যালয়-সমাজ এবং ডাকসু-রাকসু-ইকসু-চাকসু-জাকসু। সে কারণেই এসব প্রতিষ্ঠানের ভোটে দেশবাসী প্রার্থী ও প্যানেলগুলোর বৈশিষ্ট্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারা এসব নির্বাচনের ভেতর ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা খোঁজে। এটা একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব এক ঐতিহ্য।

জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রায়ণ হলে এবং জাতীয়ভাবে তারা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে সফল হলে ক্যাম্পাসকে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে না আগামী দিনে। সেটাই সবার কাম্য। সে-ই সুদিনের আগপর্যন্ত ডাকসু-রাকসু-জাকসুর সম্ভাব্য প্রতিনিধি তালিকায় জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল নেতৃত্বও দেখতে চাইবে সাধারণ মানুষ। যে শিক্ষার্থী-নেতৃত্ব সাম্য, মৈত্রী ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে আন্তরিক ও সক্রিয়, তাদের জন্য আগাম শুভকামনা।

আলতাফ পারভেজ, ইতিহাস বিষয়ে গবেষক ও প্রাক্তন ডাকসু (১৯৮৯) সদস্য