২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল: রিজভী
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল ফ্যাসিবাদের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সেদিন ফ্যাসিবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু করে। সেদিনের রক্তাক্ত তাণ্ডব গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছিল।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) আয়োজিত ‘২৮ অক্টোবর প্রেক্ষিত: লাশতন্ত্র থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের উত্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় রুহুল কবির রিজভী এ কথাগুলো বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী অডিটরিয়ামে এই আলোচনা সভা হয়।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরোধী কণ্ঠ মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতা মনে করত মন্তব্য করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ফ্যাসিবাদের বয়ানে সব সময় একটি চেতনাকে বিকৃত করে হাজির করা হয়। শেখ হাসিনার চেতনাও তা–ই, যেখানে বিরোধী কণ্ঠ মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতা মনে করত। তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণদের এই বয়ানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য ও স্বাধীনতার চর্চা করতে হবে।’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেদিনের রক্তাক্ত তাণ্ডব গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছিল, যা ছিল বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের প্রথম বহিঃপ্রকাশ।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, সেদিন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগের প্রক্রিয়ায় ছিলেন, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের কথা শুনছিল না। প্রশাসন তখন পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। সেই সুযোগেই শেখ হাসিনা ও তাঁর দল ১৪ দলের কর্মীদের দিয়ে রক্তাক্ত হামলা চালায়। এটি ছিল ফ্যাসিবাদের প্রথম মঞ্চায়ন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শাহাবুদ্দিন লাল্টুকে যেভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছিল, তা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। ঠান্ডা মাথায়, নির্মম নিষ্ঠুরতায় একজন আহত মানুষকে ইট দিয়ে থেঁতলানো এবং লাশের ওপর উল্লাস করা—এমন নৃশংসতা বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি।’
রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, ২৮ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞ ছিল পরিকল্পিত। শেখ হাসিনা তখন থেকেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক আনুগত্যে সাজাতে শুরু করেন, যেভাবে হিটলার তাঁর ‘আর্য রাষ্ট্র’ গড়েছিলেন।
ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘হিটলারের মতো শেখ হাসিনাও রাষ্ট্রপূজার বয়ান দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে রাষ্ট্র মানেই আওয়ামী লীগ। যে এই রাষ্ট্রচিন্তার বাইরে যাবে, সে দেশদ্রোহী।...বাংলাদেশে গঠিত ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রোথিত। শেখ হাসিনার সময় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচারব্যবস্থা সবকিছু দলীয় আনুগত্যে পরিচালিত হয়েছে।’
২৮ অক্টোবরের স্মৃতিচারণ করে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর আবার নতুন করে আওয়ামী লীগের ফ্যসিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। সেদিনের সেই উন্মত্ততায় বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী কিছু রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছিল আরও বেশি হতাশাজনক। তিনি বলেন, লগি–বৈঠা দিয়ে উন্মত্ত খুনের নেশা যে দলের কর্মীদের চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়, সে দলটি কোনোভাবেই রাজনৈতিক দল হতে পারে না।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর পর আজ আমরা উন্মুক্ত পরিবেশে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, সেদিনের ঘটনায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা হিসেবে এক নম্বর আসামি করে মামলা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ তদন্ত ছাড়াই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। তারা তখন লাশতন্ত্রের পাশাপাশি ‘ভয়তন্ত্র’ তৈরি করেছিল দেশে দমননীতি প্রতিষ্ঠার জন্য।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি জাহিদুর রহমান সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, এই লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসতে বলতে তিনি (শেখ হাসিনা) মূলত অস্ত্র নিয়েই ঢাকায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনাটি ছিল একটি ‘ট্রেলার’, আর তাঁর পরবর্তী ১৫ বছরের শাসনকাল ছিল সেই ট্রেলারের ‘ফুল মুভি’।
সভাপতির বক্তব্যে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বীজ বপন হয়। ২৮ অক্টোবর থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের শত্রু–মিত্র চিনতে হবে। রাজনীতিতে যদি আমরা শত্রু–মিত্র চিনতে ভুল করি, তাহলে আমাদেরকে আবার ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ, আবার দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।’
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আতাউর রহমান বিশ্বাস ও অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, গণ অধিকার পরিষদের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারুক হাসান, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম ফরহাদ প্রমুখ।