সামনে ‘চাচা-ভাতিজা’, পেছনে শাজাহান খান

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য ব্যালট বাক্স ও সরঞ্জামাদি সদর উপজেলা পরিষদ থেকে ভোট কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। মাদারীপুর, ৭ মেছবি: সাজিদ হোসেন

ভোটের আগমুহূর্তেও চেয়ারম্যান প্রার্থী চাচা-ভাতিজার পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তেজনা চলছে মাদারীপুর সদর উপজেলায়। দুই প্রার্থীই আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও ভোট কিনতে টাকা বিলানোর অভিযোগ করছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শাজাহান খান৷

চেয়ারম্যান প্রার্থী ছেলের পক্ষে কৌশলে ও গোপনে প্রচারণার কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অন্তত ৩০টি অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী পাভেলুর রহমান ওরফে শফিক খান।

প্রথম ধাপে মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল ৮ মে। আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন শাজাহান খানের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আসিবুর রহমান খান। তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পাভেলুর রহমান খান (মোটরসাইকেল)। তিনি শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, নিজের ছেলেকে প্রার্থী করে বেশ চাপে আছেন শাজাহান খান। কারণ দলের নির্দেশ অমান্য করে নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেছেন, হেরে গেলে দলের শাস্তি আসতে পারে সেটা নিয়ে শঙ্কা আছে। অন্যদিকে ছেলের বিপরীতে প্রার্থী হওয়া ভাই পাভেলুর রহমান দুইবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। পাভেলুর প্রার্থী হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ফলে ছেলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শাজাহান খান অনেকটা মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন।

মাদারীপুর সদর উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান খান। তিনি শাজাহান খানের আপন ছোট ভাই। এবারের নির্বাচনেও ওবায়দুর রহমান প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেন শাজাহান খান। পরে ওবায়দুর রহমান মনোনয়নপত্রই কেনেননি।

পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তেজনা

নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগে থেকেই ছেলের পক্ষে কৌশলে ও গোপনে প্রচারণার কাজ করছেন শাজাহান খান। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান প্রার্থী পাভেলুর রহমান। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শাজাহান খানকে সতর্ক করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শাজাহান খানকে নির্বাচনী সব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, আচরণবিধি অনুযায়ী স্থানীয় সংসদ সদস্য কারও পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। দলও সংসদ সদস্যের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সংসদ সদস্য শাজাহান খান স্থানীয় কর্মসূচির নামে প্রকাশ্যে ও গোপনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা এ-ও অভিযোগ করছেন, ভোটার, কর্মী, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িতে ডেকে এনে বা নিজে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছেন।

সর্বশেষ আজ মঙ্গলবার সকালে ও গতকাল সোমবার রাতে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন পাভেলুর রহমান। তিনি অভিযোগ করেছেন, আসিবুর রহমান ভোটারদের স্লিপের সঙ্গে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত বিতরণ করছেন।

নির্বাচন কমিশনে দেওয়া গতকালের অভিযোগে পাভেলুর রহমান বলেন, শাজাহান খান তাঁর ছেলের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা নির্বাচনী আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি তার বাড়ির ভেতরে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের একত্রে বসার উপযোগী একটি প্যান্ডেল বানিয়েছেন। যেখানে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও ভোটারদের নিজ বাড়িতে ডেকে ছেলে আসিবুর রহমান খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করে যাচ্ছেন।

তবে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মাদারীপুরে থাকলেও আমার ছেলের নির্বাচনী কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি না। আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি মাদারীপুরের নিজ বাসায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আলোচনা করি, তবে এটা নির্বাচনী কোনো বিষয় না।’

এর আগে ২৯ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ১৫টি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন পাভেলুর রহমান। তিনি অভিযোগ করেন, শাজাহান খান দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য থাকায় এবং সাবেক মন্ত্রী হওয়ার কারণে অবৈধ সম্পদ ও বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। সেই কালোটাকা দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে টাকার প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, সন্ত্রাসী বাহিনী, কিশোর গ্যাং, ভূমিদস্যু, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের নিয়ে নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টা করছেন।

পাভেলুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর ৫ মে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন আসিবুর রহমান। তিনি চাচা পাভেলুর রহমান ও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। আসিবুর রহমান অভিযোগ করেন, পাভেলুর রহমান নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে লাগাচ্ছেন। ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে ভোট কিনতে টাকা বিলাচ্ছেন। পরাজয় জেনে নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তাঁর চাচা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার পাঁয়তারা করছেন।

দ্বন্দ্ব আরও প্রকাশ্যে এসেছে

একসময় ভাই শাজাহান খানের সঙ্গেই রাজনীতি করতেন পাভেলুর রহমান। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। পাভেলুর রহমান ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মাদারীপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। দল থেকে শাজাহান খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

এরপর একবার কিছুদিনের জন্য দুই ভাই কাছাকাছি এসেছিলেন তবে গত কয়েক বছর ধরে বেশ দূরত্ব।ফলে একই পরিবারের অংশ হলেও পাভেলুর রহমান এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে শাজাহান খানের  দ্বন্দ্ব রয়েছে। বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী হওয়ায় এখন জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাভেলুর রহমানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ আসিবুর রহমানকে সমর্থন দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে।

দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রকাশ্যে আসিবুর আর পাভেলুরের লড়াই হচ্ছে। কিন্তু আসলে লড়াই চলছে শাজাহান খান আর বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারীদের মধ্যে।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, শাজাহান খান দলীয় সিদ্ধান্ত মানছেন না। আচরণবিধিরও তোয়াক্কা করছেন না। শাজাহান খান তাঁর ক্ষমতার প্রভাবে সবকিছু নিজের করে নিতে চান। তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে আমরা আওয়ামী লীগ বিব্রত।

ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২৮৩ দশমিক ১৪ কিলোমিটার আয়তনের সদর উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ২২ হাজার ৪২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৬ হাজার, নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪২১। আর পাঁচজন আছেন অন্যান্য ভোটার।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রিটার্নিং কর্মকর্তা সদর উপজেলার মোট ১১৭টি ভোটকেন্দ্রের সবগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। চেয়ারম্যান পদের দুই প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রদর্শনীর অভিযোগ জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ভোটারদের মনে ভোটের দিন কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি খান মো. শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, একই দলের দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। মারামারি না হলেও পাল্টাপাল্টি অনেক অভিযোগ করলেও সেভাবে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ভোটের দিন আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হতে পারে।

তবে মাদারীপুর জেলা নির্বাচন ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আহমেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সদর উপজেলার সবগুলো কেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন,  নির্বাচনের দিন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।