বছর গেল নির্বাচনের অপেক্ষায়

বিদায়ী ২০২৫ সালের রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ছবির কোলাজছবি: প্রথম আলো

অভ্যুত্থানের পর ২০২৫ সালের শুরু থেকেই মূল আলোচনা ছিল নির্বাচন কবে হবে? বছরের একেবারে শেষ মাসে এসে ভোটের তারিখ ঘোষণা করা হয়। বছরের প্রথম অর্ধেকটা কেটেছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং সংস্কার নিয়ে। শেষ পর্যন্ত গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ মেনে সংস্কারের সিদ্ধান্ত এসেছে। ভোটের তারিখও ঠিক হয়েছে। আলোচনার আরেকটি বড় বিষয় ছিল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন? সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনিও ফিরেছেন ২৫ ডিসেম্বর। তবে রাজনীতিতে সব ছাপিয়ে যায় বছরের বিদায়লগ্নে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদায়। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটল গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা দ্যুতি ছড়ানো গৌরবময় একটি অধ্যায়ের।

গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক গন্তব্য কী হয়, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল ছিল বছরের শুরুতে। গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠনে এই প্রশ্নের জবাব মেলে। ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার মধ্যদিয়ে দেশে যখন নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়, এর পরদিনই ঘটে বিপত্তি। ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় ১৮ ডিসেম্বর। এর জেরে ফুঁসে ওঠে তাঁর সমর্থকেরা। খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত আছে।

২০২৫ সালে রাজনীতি শুধু আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ ছিল না। নির্বাচন ও সংস্কারের দাবিতে রাজপথে সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে রাজনৈতিক দলগুলো। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের শক্তিরও জানান দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। বিশেষ করে বিএনপি বলয়ের বাইরে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কিছু ইসলামপন্থী দল ঢাকায় বড় জমায়েত করে। এর মাধ্যমে তারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করার ইঙ্গিত দেয়।

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ১৭ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ হারায়। বিচ্ছিন্নভাবে নানা সময় মিছিল করার চেষ্টা করেছিল দলটি, তার সঙ্গে ককটেল ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক তৈরির অভিযোগও উঠেছে দলটির বিরুদ্ধে।

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক সন্ধিক্ষণের বছর। পুরোনো রাজনীতির ক্লান্তি, নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা, সহিংসতার ভয় এবং সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা—সবকিছু একসঙ্গে এগিয়েছে। তবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির ভোটের ঘোষণাই সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। কারণ, এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ এবং দেশে স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে।

কোন দলের কারা কারা জুলাই সনদে সই করল, তা দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সমঝোতার নথি জুলাই সনদ, গণভোট

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনীতিতে বড় জায়গা করে নেয় সংস্কার। পুরোনো স্বৈরতান্ত্রিক ধারা ভেঙে নতুন রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ধারা তৈরির চাপ বাড়তে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারও সংস্কারের ওপরই গুরুত্ব দেয়।
২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে একটি সম্মতিভিত্তিক দলিল প্রণয়ন, যার নাম হবে জুলাই সনদ। এর আগে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এসব কমিশনের কাজ ছিল নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধানিক কাঠামো, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করা। বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ এক জায়গায় সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে প্রায় আট মাস পর সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে। ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। সরকার ১৩ নভেম্বর ঘোষণা করে সংস্কার বাস্তবায়নে গণভোট হবে এবং তা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই হবে।

সব পক্ষ সন্তুষ্ট না হলেও জুলাই সনদ দেখিয়ে দেয়, সংঘাতের পাশাপাশি আলোচনার রাজনীতিও এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। ২০২৫ সালে এটি ছিল এমন এক মুহূর্ত, যখন রাজনীতি সাময়িকভাবে হলেও উত্তাপ কমিয়ে আলোচনার টেবিলে বসেছিল।

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নতুন দলটির নেতারা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নতুন রাজনীতির ঘোষণা দিয়ে এনসিপি

ফেব্রুয়ারিতে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ছিল ২০২৫ সালের অন্যতম আলোচিত নতুন রাজনৈতিক ঘটনা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ ও নাগরিক আন্দোলনের মুখগুলো সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে উঠে আসে। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতিতে।

পুরোনো দলগুলোর প্রতি জন অসন্তোষকে তারা ভাষা দেয় নতুন বন্দোবস্তের দাবিতে। কেউ একে দেখেছেন আশার আলো হিসেবে, কেউ দেখেছেন পরীক্ষামূলক রাজনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে।

বছরজুড়ে এনসিপি নানাভাবেই আলোচনায় থাকে। তবে ভেতরে-ভেতরে নানা মতবিরোধের কথাও বের হতে থাকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে অনেকেই দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নারী নেত্রীও রয়েছেন। শাপলা কলি প্রতীকে এনসিপি প্রথমবার আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়ার আগেই সংকটে পড়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারির ভোটের পর বোঝা যাবে, তরুণদের দলটি মানুষের মনে কতটা দাগ কাটতে পারল।

শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে গত ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচিতে ইনকিলাব মঞ্চ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ওসমান হাদির হত্যা, রাজনীতিতে উত্তাপ

ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে হাদীকে লক্ষ্য করে রাজধানীর বিজয়নগর (পল্টন) এলাকায় দুই দুষ্কৃতকারী মোটরসাইকেলে চড়ে গুলি চালায়। গুলিটি হাদির মাথায় লাগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে পরিস্থিতি ক্রমে সংকটাপন্ন হয়ে উঠে। ১৫ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। ১৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।

পরে পুলিশ জানায়, ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশে মোটরসাইকেলে বসে গুলি চালান ফয়সাল করিম মাসুদ। তিনি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা। আর মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন তাঁর সহযোগী আলমগীর শেখ। তাঁরা দুজনই ভারতে পালিয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বছরজুড়েই আলোচিত চরিত্র ছিলেন ওসমান হাদি, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন এবং ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে। ওসমান হাদির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৯ ডিসেম্বর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে শহীদ ওসমান হাদির জানাজায় লাখো মানুষ অংশ নেয়।

ইনকিলাব মঞ্চের নেতারা ঘোষণা করেন, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। গত শুক্রবার থেকে রাজধানীর শাহবাগ অবরোধ করে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। এখন সারা দেশের বিভাগীয় শহরে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে ইনকিলাব মঞ্চ।

গত ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার পর গণসংবর্ধনার মঞ্চে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

তারেক রহমানের আলোড়িত প্রত্যাবর্তন

দুই যুগ আগে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হলেও বিএনপিতে তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল মা খালেদা জিয়ার সহযোগী হিসেবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠালে বিদেশে থেকে দল পরিচালনার দায়িত্ব নেন তারেক রহমান। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বন্দী অবস্থা থেকে বের হয়ে সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান তিনি। মা কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। এরপর প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে বিদেশে থেকেই বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে তারেক রহমানের ফেরার আশায় ছিলেন বিএনপির সমর্থকেরা। কিন্তু স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসছিল না। তার মধ্যে গত নভেম্বরের শেষে তারেক রহমান যখন জানান, তাঁর দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়; তখন নানা গুঞ্জন ডালপালা মেলে।

তবে সব গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরেন তারেক রহমান। দেশে তাঁর প্রত্যাবর্তনটি হয় রাজসিক, বিপুল মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। বিশাল সমাবেশে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৭ বছর নির্বাসনের পর তাঁর উপস্থিতি বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে নতুন উদ্যম ও আশা সৃষ্টি করে। তারেকের নেতৃত্বেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে বিএনপি। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁকে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হয়।

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্পষ্ট সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘ নির্বাসনও তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবকে ক্ষয় করতে পারেনি; বরং তার ফেরা বিএনপির উদ্যমে নতুন রসদ জোগাচ্ছে। দলের অভ্যন্তরীণ সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে।

বছরের শেষ লগ্নে তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যু শোকাকূল করে অগুনতি সমর্থকদের
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

খালেদা জিয়ার জীবনাবসান

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একধরনের জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হন। সব দল-মতের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানের আসনে বসানো হয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে কারাবন্দী করার পর তাঁর অসুস্থতা আরও বাড়ে। মুক্তির পরও মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল তাঁকে। অসুস্থতা বাড়লে গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠলে বিদেশে নেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল, ঠিক করা হয়েছিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু ভ্রমণের ধকল নেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় দেশেই চলে চিকিৎসা। তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গত ৩০ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা রাজনৈতিক খবরই শুধু নয়, জাতীয় আবেগে পরিণত হয়েছিল। তাঁর সুস্থতার জন্য সরকারেরর পক্ষ থেকে দোয়া চাওয়া হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে গোটা দেশ। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে সরকার, একদিন সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়।

স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আকস্মিক রাজনীতিতে এলেও খালেদা জিয়া তাঁর পরবর্তী জীবন বর্ণিল করেছেন সংগ্রামমুখর এক পথচলায়। বিশ্লেষকেরা বলেন, জিয়াউর রহমান বিএনপি দলটি গঠন করলেও এর গণভিত্তি তৈরি হয় খালেদা জিয়ার মাধ্যমেই। আপসহীন নেত্রীর অভিধা নিয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। তাঁরপর ২০০১ সালে আবার সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কারাগারে যেতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ভিন্ন মাত্রার নির্যাতন নেমে আসে খালেদা জিয়ার ওপর। প্রথমে তাঁকে সেনানিবাসের মইনুল রোডের স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িছাড়া করা হয়। এরপর বাড়ি ও কার্যালয় অবরুদ্ধ করে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা সংকুচিত করা হয়, শেষে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড দিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে।

তবে খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গেই মোকাবিলা করেন এসব পরিস্থিতি। গত এক বছরে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সবাই। ফলে তাঁর মৃত্যুকে বিএনপি যেমন বলছে মহাকালের এক সমাপ্তি; তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গন দেখছে এক বিশাল শূন্যতা হিসেবে, বিশেষ করে এই অনিশ্চিত সময়ে।