গণহারে বহিষ্কার নিয়ে প্রশ্ন বিএনপিতে

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় একযোগে ৭৩ জনকে বহিষ্কার করার পর গতকাল আরও তিনজনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এই মুহূর্তে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে জোর আলোচনা, এ নির্বাচন ঘিরে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারের তালিকা কত দীর্ঘ হবে।

গণহারে দল থেকে এই বহিষ্কার তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে; দলকে আরও দুর্বল করবে কি না, এসব প্রশ্নও উঠেছে বিএনপিতে। তবে কঠোর অবস্থানেই থাকছেন দলটির নেতৃত্ব।

দলীয় নির্দেশ অমান্য করে ভোটে অংশ নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন—বিএনপির এমন নেতাদের অনুমান, উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপ পর্যন্ত বহিষ্কারের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই শতে গিয়ে ঠেকতে পারে।

এই বহিষ্কার (দলে) কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, বিএনপি দুই-আড়াই শ নেতা-কর্মীর দল নয়। যাঁরা নির্বাচন করছেন, সেখানে একই মাপের একই যোগ্যতার অনেক নেতা আছেন। কিছু সুবিধাবাদী মনোবৃত্তির নেতা নির্বাচন করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বরং জাতির কাছে তাঁদের মুখোশ খুলে গেল।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী

নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, এবার কমবেশি ৪৮০ উপজেলা পরিষদে চার ধাপে ভোট হবে। প্রথম ধাপে ভোট হবে আগামী ৮ মে। এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে, ২৯ মে তৃতীয় ও ৫ জুন চতুর্থ ধাপের নির্বাচন হবে। ইতিমধ্যে সব ধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার ৭৩ জনসহ দুদিনে ৭৬ জনকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

গতকাল শনিবার যে তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়, তাঁরা হলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা বিএনপির সদস্য আবদুল হামিদ, শেরপুরের শ্রীবরদী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি গোলাম মোস্তফা ও রাঙামাটির কাউখালী উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা মংসুইউ চৌধুরী। তাঁদের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

অবশ্য প্রথম ধাপে ৭৩ জনকে বহিষ্কার করার পর বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া অন্তত চারজন নেতা গতকাল শনিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা নির্বাচন করবেন না। তাঁদের একজন মেহেরপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রোমানা আহমেদ। তিনি সদর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচন না করার কথা জানিয়ে কেন্দ্রে চিঠি লেখার কথা তিনি গতকাল প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন।

রোমানা আহমেদ চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলের সিদ্ধান্তই সঠিক। আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’

যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেসব কারণ এখনো বহাল আছে; বরং একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল আরও কর্তৃত্ববাদী হয়েছে।

দীর্ঘ হবে বহিষ্কারের তালিকা

যদিও প্রথম ধাপে ৭৬ জন বহিষ্কারের পর সামনের ধাপগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে বিএনপি নেতাদের কারও কারও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে, অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে এত বহিষ্কার মাঠপর্যায়ে দলকে আরও দুর্বল করবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে বিএনপিতে।

তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বহিষ্কার (দলে) কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, বিএনপি দুই-আড়াই শ নেতা-কর্মীর দল নয়। যাঁরা নির্বাচন করছেন, সেখানে একই মাপের একই যোগ্যতার অনেক নেতা আছেন। কিছু সুবিধাবাদী মনোবৃত্তির নেতা নির্বাচন করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বরং জাতির কাছে তাঁদের মুখোশ খুলে গেল।’

সংসদ নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মাথায় অনুষ্ঠেয় উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেন বিএনপির নেতৃত্ব। বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, এর পেছনে দলের নীতিনির্ধারকদের নানা ব্যাখ্যা-যুক্তি আছে। তাঁরা মনে করেন, এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেসব কারণ এখনো বহাল আছে; বরং একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল আরও কর্তৃত্ববাদী হয়েছে।

নেতাদের যুক্তি

বিএনপির নেতারা এ-ও মনে করছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো উপজেলা নির্বাচন করছে না। বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন নির্বাচন না করায় এ নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই থাকছে না। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন হাস্যকর হয়ে যাবে। এ ছাড়া গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে সহিংসতার পর প্রায় ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কারাবন্দী। অসংখ্য মামলায় সারা দেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী আদালতে ঘুরছেন। এর বিরুদ্ধে বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এখনো আন্দোলনে আছে। এ পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে।

উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে দলের ৯৮ শতাংশ নেতা-কর্মীর মনোভাব নেতিবাচক বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাঠের কর্মীরা—যাঁরা মামলার আসামি, আদালতে হাজিরা দেন, তাঁদের ন্যূনতম উৎসাহ নেই এই নির্বাচনে। বরং গ্রেপ্তার, মামলা আর আদালতের হাজিরার মধ্যে এই নির্বাচনকে তাঁরা বোঝা মনে করছেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটি দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরও দলের যাঁরা প্রথম ধাপের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের ফেরানোর জন্য সাংগঠনিকভাবে নানা উদ্যোগ-তৎপরতা নেওয়া হয়। এরপরও চেয়ারম্যান পদে ২৮ জনসহ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত (পুরুষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ) ৭২ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনও আওয়ামী লীগের এক দলের নির্বাচন হবে। সব উপজেলায় তাদের একাধিক প্রার্থী রয়েছে।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নেতা-কর্মীদের বলেছি, ওরা ওরা মারামারি করুক, ওগো নির্বাচন ওরা করুক। আমরা এর মধ্যে যাব না।’