অবিলম্বে জুলাই সনদের বাস্তবায়নসহ চার দফা দাবি আদায়ে কয়েকটি দলের যুগপৎ কর্মসূচি ঘিরে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।
গতকাল রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়।
বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বৈঠকে কয়েকটি রাজনৈতিক দলেন যুগপৎ আন্দোলনে নামার প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোতে সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। অবরোধের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। আলোচিত একটি দল এই আন্দোলনে নেই বললেও শেষ সময়ে তারাও যুক্ত হতে পারে। তখন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল একা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঝটিকা মিছিল ও জামিন প্রসঙ্গে
বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে একটি সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে ফাটল ধরার সুযোগ নিচ্ছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে অনৈক্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আগে ঝটিকা মিছিল দেখলে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করত। যেটা এখন কমে গেছে। এতে করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মিছিলের প্রবণতা বাড়ছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ঝটিকা মিছিলে যারা আসছে, তাদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে বরগুনা, বরিশাল, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে বলে তাঁরা তথ্য পাচ্ছেন।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর প্রধান বলেন, এসব মিছিলে জড়িত নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। গ্রেপ্তারের পর তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু এ ধরনের আসামিরা অনেকে দ্রুত আদালত থেকে জামিনে পেয়ে যাচ্ছে।
একপর্যায়ে বৈঠকে একজন উপদেষ্টা বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে বিচার বিভাগে দলীয় বিবেচনায় অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা জামিন দিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশের প্রতিবেদনও ঠিক থাকে না। এ কারণেও জামিন হয়ে যায়।
সভায় সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা কম সময়ের মধ্যে কীভাবে জামিন পাচ্ছে, তা অনুসন্ধানে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পুলিশের কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি প্রতি সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় জামিনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবে।
মাহফুজের নিরাপত্তা, ডাকসু, জাকসু প্রসঙ্গে
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, লন্ডনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল বলে বৈঠকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি জানান। তিনি বলেন, যে গাড়িতে ডিম ছোড়া হয়েছে, ওই গাড়িতে তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন না। তিনি অন্য গাড়িতে ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ জাকসু নির্বাচন নিয়েও কোর কমিটির সভায় আলোচনা হয়। বলা হয়, দুটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। জাকসুতে যা হয়েছে, সেটি তাঁদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা।
কারাগারে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা নিজ খরচে চিকিৎসা নিতে চান। এ জন্য আইন সংশোধন করা যায় কি না, তা নিয়েও কারা কর্তৃপক্ষের দিক থেকে আলোচনা তোলা হয়।
প্রতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। গতকালের সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও কারা মহাপরিদর্শকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যুক্ত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার কর্মকর্তারা অংশ নেন।
যাবজ্জীবনের মেয়াদ কমানোর চিন্তা
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বেশি বয়স্ক বন্দীদের মুক্তির কথা বিবেচনায় রেখে সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ কমানোর চিন্তাভাবনা করছে। তিনি বলেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ বর্তমানে ৩০ বছর। বয়স বিবেচনায় নারীদের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ হতে পারে ২০ বছর। পুরুষদের ক্ষেত্রে সেটা আরেকটু বেশি হবে। তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের এ বিধান নির্ভর করবে সাজার সময়কালে আসামির বয়সের ওপর। এ বিধান এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এতে কিছু শর্ত যুক্ত থাকবে।
সড়ক অবরোধ বরদাশত করা হবে না
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসে ফরিদপুর-৪ আসনের অধীন ভাঙ্গা উপজেলার দুটি ইউনিয়নকে ফরিদপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সেখানে জাতীয় মহাসড়ক অবরোধ করে যে আন্দোলন চলছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। তারা যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে সবকিছু শোনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই এলাকার জনগণের যে অভিযোগ, সেটা তারা যথাযথ চ্যানেলে আবেদন করতে পারে। কোনোভাবেই সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা যাবে না। তিনি বলেন, সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন আর কোনো অবস্থায় বরদাশত করা হবে না। তারা যদি অবরোধ তুলে না নেয়, সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে।