সরকার সেই খেলা শুরু করেছে 

মির্জা ফখরুলের অভিযোগ, বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে গত নির্বাচনের আগে ‘গায়েবি মামলা’ হয়েছিল, সেটা নতুন করে শুরু হয়েছে। 

সিলেটে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বিকেলে নগরের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে
ছবি: আনিস মাহমুদ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেভাবে সারা দেশে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি মামলা’ দেওয়া হয়েছিল, সেটা এখন আবার শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘সরকার আবার নতুন করে সেই খেলা শুরু করেছে। মামলা মামলা খেলা, গায়েবি মামলা। কোনো কিছু ঘটে নাই, হঠাৎ বলে দিল এখানে নাকি নাশকতা হয়েছে। কেউ জানে না, এখানে কিছু হয়েছে কি না।’ 

গতকাল শনিবার সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মির্জা ফখরুল ইসলাম এ কথা বলেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে বলেন, এবার মানুষ জেগে উঠেছে। হুমকি-ধমকি দিয়ে কোনো লাভ হবে না।

সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বেলা সাড়ে ১১টায় সমাবেশ শুরু হয়। বিকেল পাঁচটায় মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। 

এর আগের অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতো সিলেটের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট ছিল আশপাশের তিন জেলা—হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধর্মঘট ছিল সিলেটে। বিএনপির সমাবেশ শেষ হওয়ার পর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আবার বাস চলাচল শুরু হয়ে যায়।

পরিবহন ধর্মঘটসহ যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিএনপির আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে বিএনপির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের অনেকে তিন দিন আগে থেকে সমাবেশস্থল আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে আসা শুরু করেন। অনেকে মাঠেই রাত কাটান, সেখানে তাঁদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশের আগে রাতেই মাঠ ভরে যায়। গতকাল সকাল নাগাদ নেতা-কর্মীদের জটলা মাঠের আশপাশের চৌহাট্টা, রিকাবীবাজার ও দরগাগেট সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। বেলা দুইটায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও শুরু হয় বেলা সাড়ে ১১টায়। দুই–তিন দিন ধরে মাঠে অবস্থানের ঝক্কি এবং দূরের জেলা-উপজেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্লান্তির রেশ দেখা যায় সমাবেশে। দুপুরের পর থেকে অনেকে মাঠ ছাড়তে শুরু করেন।

সমাবেশ শুরুর আগে সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে সেখানকার মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের পর থেকে শহরের অন্যান্য এলাকারও ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। সন্ধ্যার পর ইন্টারনেটের গতি আবার স্বাভাবিক হয়।

ভোট এবার জনগণ কড়ায়–গণ্ডায় বুঝে নেবে

আওয়ামী লীগ সরকার কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত—এ প্রশ্ন তুলে বিএনপির মহাসচিব বলেন,‘২০১৪ সালে ভোট হয়েছিল? ভোটকেন্দ্রে কুকুর শুয়ে ছিল। যেটাকে প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান বলেছিলেন কুত্তা মার্কা নির্বাচন। আর ২০১৮ সালে আগের রাতেই ভোট শেষ। তারপরও বলে, আমরা ভোটে জিতেছি।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ মুহূর্তে সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ। যারা এর বিরোধিতা করবে, তারা গণশত্রু হিসেবে ধিক্কৃত হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, এই সংসদকে বিলুপ্ত করতে হবে। আর নির্বাচনের জন্য একটা কেয়ারটেকার সরকার তৈরি করতে হবে। পুলিশ দিয়ে, আমলা দিয়ে, গোয়েন্দা দিয়ে তুমি রাতের অন্ধকারে সবকিছু পাল্টে দেবে, ইভিএমে ভোট করবা—এটা হবে না। জনগণ তার ভোট এবার কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেবে।’

ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বহু লম্বা লম্বা কথা বলে। বলে কী, সংবিধান অনুযায়ী নাকি নির্বাচন হবে। কোন সংবিধান? যে সংবিধান তুমি ১০ বার কাটাছেঁড়া করেছ, যে সংবিধান তুমি নিজে নিজে তৈরি করেছ, বিচার বিভাগকে পকেটস্থ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে বাতিল করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছ, সেই সংবিধান আমরা মানি না।’

মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিল অধিকার আদায়ের জন্য, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য, কথা বলার স্বাধীনতার জন্য। সেই অধিকারগুলোকে হরণ করার জন্য, চুরি করার জন্য, ডাকাতি করার জন্য, মানুষের স্বপ্নকে খানখান করে দেওয়ার জন্য এই সরকারের বিচার হবে জনতার আদালতে।

আমরা কোনো অশান্তি চাই না

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটাই, হারিয়ে যাওয়া অধিকারকে আমরা ফিরিয়ে আনব। আমাদের ভোটের অধিকারকে আমরা ফিরিয়ে নেব। আমরা আমাদের সরকার আমরা তৈরি করতে চাই, জনগণ তৈরি করতে চায়। আমার ভোট আমি দেব, যাঁকে খুশি তাঁকে দেব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেশে শান্তি চাই। আমরা বারবার করে বলছি, আমরা কোনো অশান্তি চাই না। আমাদের দফা এক দাবি এক, এই সরকারের পদত্যাগ।’ দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম।

ছাত্রলীগের মোটরসাইকেল মহড়া

বিএনপির এই গণসমাবেশ ঘিরে প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে সিলেট বিভাগের চার জেলায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ হয়েছে। বিএনপির এ কর্মসূচি উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে শহরের মোড়ে মোড়ে সতর্ক পাহারায় দেখা যায়। তবে সমাবেশ ঘিরে গতকালও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়েছে। বিকেল পাঁচটায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন সমাবেশস্থলের পাশের এলাকা চৌহাট্টা অতিক্রম করে ছাত্রলীগের মোটরসাইকেল বহর। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবারের মহড়ার বিষয়টা জানি। আজকের (শনিবার) বিষয়টি জানি না। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে সেদিন (বৃহস্পতিবার) ছাত্রলীগ যেভাবে মহড়া দিয়েছে, এতে আমরা আশাবাদী। তবে ছাত্রলীগ নিজেদের মতো করে কর্মসূচি করেছে।’ 

পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা আলোচনা ও আশঙ্কার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে পেরেছে। এ কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে, জানতে চাইলে মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপির কর্মসূচিতে ২০ থেকে ৩০ হাজার লোক হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া, রাজকীয় খাওয়াদাওয়াসহ যে তোড়জোড় তারা করেছে, সে অনুয়ায়ী মানুষ কই?’ তাঁর দাবি, ‘বিএনপির আহ্বানে এখন মানুষ সাড়া দেয় না।’

খেলা আগে শেখেন

বিএনপির এ সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। ‘খেলা হবে’—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সভা–সমাবেশে প্রায়ই এ কথা বলছেন। এ বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের খেলতে চান, খেলা আগে শেখেন। আনাড়ি টিমের সঙ্গে বিএনপি খেলে না। পুলিশ দিয়ে বিএনপি খেলে না। খেলতে চাইলে ক্ষমতা থেকে নেমে আসুন। খোলা মাঠে খেলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে খেলেন।’

সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ও ফজলুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর, সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান, সাবেক সংসদ সদস্য নাসের রহমান, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন প্রমুখ।

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলের পাঁচ নেতা-কর্মীকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে; বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে ধারাবাহিক গণসমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিএনপি এ সমাবেশ করে। এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও ফরিদপুরে সমাবেশ হয়। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শেষ হবে। তার আগে ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় এবং ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে গণসমাবেশ হবে।