নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কোনো উদ্বেগ নেই

জার্মানির মিউনিখ সফর–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল গণভবনে
পিআইডি

জার্মানি সফরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই, মন্তব্য নেই, প্রশ্নও নেই। তারা নিজেরাই জানত নির্বাচনে আমি জিতে আসব। যারা আমাকে চায়নি, তাদের মাধ্যমেই কথা ওঠে, প্রশ্ন ওঠে।’

গতকাল শুক্রবার সকালে গণভবনে জার্মানি সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর জার্মানি সফর সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমার সংকট, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, দেশে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সংসদ নির্বাচনসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব দেশের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে ১০-১২ দিন লাগল, সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু। আর বাংলাদেশে এত সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল আসল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে দেশ ফলাফল দিল, সেটা অবাধ, সুষ্ঠু না?

মার্চের দিকে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে—নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর এমন একটা বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চান একজন সাংবাদিক। আগের বক্তব্যের বাস্তবতা এখনো বিরাজমান আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ষড়যন্ত্র তো ছিল, ষড়যন্ত্র আছে। যারা নির্বাচন বানচালের পক্ষে ছিল, তারা যখন দেখল যে নির্বাচন কিছুতেই আটকাতে পারবে না; কারণ, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। তখন চক্রান্ত হলো যে জিনিসের দাম বাড়বে। সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। তখন চক্রান্ত করে সরকারকে উৎখাত করবে। এটা তাদের পরিকল্পনার অংশ।

রাজনৈতিক দলের অভাব

দেশে রাজনৈতিক দলের অভাব রয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে গঠিত হয়েছিল গণমানুষের কথা বলে। সেই সময় থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে গেছে। অন্যান্য দল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একটা তো যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত, যাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। পাসপোর্ট নিয়ে যারা পাকিস্তান গেছে, তাদের ফিরিয়ে এনে ভোটের অধিকার দিয়েছে। জাতির পিতা হত্যাকারীদের পার্লামেন্টে নিয়ে খালেদা জিয়া বসিয়েছিল।’

বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সামরিক স্বৈরশাসকদের পকেট থেকে তৈরি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতার উচ্চ আসনে বসে যে দল তৈরি হয়, তাদের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। তারা চায় কেউ তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। সেটা করতে গিয়ে তারা ২০০৮-এর নির্বাচনে ধরা খায়। এরপর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে।

রোজায় কোনো পণ্যের অভাব হবে না

আসন্ন রোজায় কোনো পণ্যের অভাব হবে না জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ইতিমধ্যে সব ব্যবস্থা করা আছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘রমজান তো কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য। রমজানে মানুষ কম খায়। কিন্তু আমাদের সাইকোলজি হচ্ছে রমজান এলে যেন খাওয়া-দাওয়ার চাহিদাটা বেড়ে যায়। রমজানে যে জিনিসগুলো বেশি দরকার, যেমন ছোলা, খেজুর, চিনি—এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে আনার ব্যবস্থা আছে। কাজেই এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।’

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় না, যারা সরকার উৎখাত করতে চায় তাদেরও কিছু কারসাজি আছে। এর আগে পেঁয়াজের খুব অভাব। দেখা গেল বস্তাকে বস্তা পচা পেঁয়াজ পানিতে ফেলে দিচ্ছে। এই লোকগুলোকে কী করা উচিত। এদের গণধোলাই দেওয়া উচিত।

বিশ্ব মোড়লদের দুমুখো নীতি

ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন নিয়ে বিশ্ব মোড়লেরা দুমুখো নীতি পালন করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধের ভুক্তভোগী আমরা। আমাদের বিশ্ব মোড়লেরা দুমুখো নীতিতে বিশ্বাস করে। ফিলিস্তিনের সমস্ত জমি দখল করে রেখেছে, ওটা ইনভেশন না। কিন্তু ইউক্রেনেরটা ইনভেশন। এই দুমুখো নীতি কেন হবে? সেটা আমার প্রশ্ন ছিল। আমি বলেছি। অনেকেই সাহস করে বলবে না।’

মিয়ানমার ইস্যুতে সংশ্লিষ্টদের ধৈর্য ধরার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি বারবার। আসলে মিয়ানমারের অবস্থা এত খারাপ! আর বিশ্বনেতৃত্বের সঙ্গে যখন কথা বলি, সবাই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখান। কিন্তু আসলে এদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর কিছু হচ্ছে না। এটা হলো বাস্তবতা।’

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মধ্য ও উঠতি শক্তির দেশগুলোকে নিয়ে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির চিন্তা প্রধানমন্ত্রী করছেন কি না জানতে চান একজন সাংবাদিক। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি সাধারণ একজন মানুষ। ছোট একটা ভূখণ্ডে বিশাল জনগোষ্ঠী। আমি সেটা নিয়েই ব্যস্ত। তবে কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে আমি আমার কণ্ঠ সোচ্চার করি। প্রতিবাদ করি। যুদ্ধ চাই না। শান্তি চাই—এই কথাটা বলি। কিন্তু কোনো প্ল্যাটফর্ম করার মতো দক্ষতা আমার নেই। সেই চিন্তাও আমার নেই।’ তিনি আরও বলেন, অনেক প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেছে। কিন্তু কাজের সময় কাজে লাগে না। আজকে গাজায় যুদ্ধ বন্ধে নিরাপত্তা কাউন্সিলে প্রস্তাব আসে। সেখানে ভেটো দেওয়া হয়।

সংকেত বাতি মেনে যান চলাচল

যানজট নিয়ন্ত্রণে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) গত বৃহস্পতিবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেট্রোরেল ও ঢাকা উড়ালসড়ক চালুর পর গাড়ির চাপ কমেছে। ফলে ট্রাফিক সিগন্যালে সংকেত বাতি সচল করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই কেউ নিতে পারবে না

টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে ভারত সরকার। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অলরেডি আমরা আবেদন করেছি। কয়েক দিন আমি সমানতালে টাঙ্গাইলের শাড়ি পরলাম এ জন্য যে যাতে দেখাতে পারি এটা আমাদের। কাজেই এটা অন্য কেউ নিতে পারবে না।’

গণমাধ্যমকর্মী ও মালিকদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এক প্রশ্নকর্তা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সংসদে আনার চেষ্টা করেন। দীর্ঘদিন সামরিক স্বৈরশাসন চলেছে। এ জন্য গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সুযোগ কম ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেটা চেষ্টা করছে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন, শেখ সেলিম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।