বিএনপির সাজাপ্রাপ্ত নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ এখনো আত্মগোপনে 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় ১৪০ মামলায় বিএনপির ১৮০০ নেতা-কর্মীর সাজা হয়।

৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রায় ১ হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড হয়। তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন অন্তত ৩১ জন। তাঁদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে সাজাপ্রাপ্তদের বড় অংশ এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের পর পুলিশের ধরপাকড় কমে আসায় সাজা হওয়া নেতা–কর্মীদের অনেকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছেন। ২১ মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আত্মসমর্পণকারী নেতা-কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৫০। তাঁদের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়েছেন ২০০ জনের মতো। আর কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়েছেন ২৬ জন, ৫ জন এখনো কারাগারে। 

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের একের পর এক সাজা হয়েছিল। তাঁরা এখন আদালতে আত্মসমর্পণ করছেন। কেউ কেউ জামিন পেয়েছেন। অনেকে কারাগারে আছেন।

কেবল ১ এপ্রিল থেকে ২১ মে পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাজাপ্রাপ্ত ৮২ নেতা-কর্মী ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। 
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল

আত্মসমর্পণকারীদের একজন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া (জুয়েল)। পাঁচ মামলায় তাঁকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব মামলার রায় হয়। তিনি গত ১৭ এপ্রিল ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। পরে সাজার রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেন। পাঁচ মামলায় জামিন পেয়ে ২১ মে তিনি কারামুক্ত হন। 

আইনজীবী ও দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, আবদুল কাদের ভূঁইয়ার মতো বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের দণ্ডিত অন্তত ২৫০ নেতা-কর্মী ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। এক থেকে দেড় মাস কারাভোগের পর অন্তত ২০০ নেতা-কর্মী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। অন্যরা কারাগারে আছেন।

দণ্ডিত নেতা-কর্মীদের একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত মার্চের পর থেকে দণ্ডিত নেতা-কর্মীরা আত্মসমর্পণ শুরু করেন। এপ্রিলের শুরু থেকে সেটা বাড়তে থাকে।

নির্বাচনের আগে পৃথক দুটি মামলায় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিনের (টুকু) পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। তিনি গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

আত্মসমর্পণ করা অন্তত ৫০ নেতা-কর্মীর আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদুল ফিতরের আগে তাঁর অনেক মক্কেল জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, কেবল ১ এপ্রিল থেকে ২১ মে পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাজাপ্রাপ্ত ৮২ নেতা-কর্মী ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। 

আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের ২০ নভেম্বর পল্টন ও নিউমার্কেট থানার দুটি মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খানকে (সোহেল) আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। পরে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর পল্টন থানার আরেক মামলায় তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিন মামলায় দণ্ডিত এই নেতা ৩১ মার্চ ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি আপিল করলে আদালত তাঁকে জামিন দেন, ১৩ মে মুক্তি পান তিনি।

নির্বাচনের আগে পৃথক দুটি মামলায় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিনের (টুকু) পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। তিনি গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তাঁর আইনজীবী নিহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে তাঁর অনেক মক্কেলের সাজা হয়েছিল। অন্তত ১৫ জন দণ্ডিত নেতা-কর্মী আত্মসমর্পণের পর জামিন পেয়েছেন। 

আইনজীবী ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যান্টনমেন্ট থানায় করা তিনটি মামলায় গত ডিসেম্বরে ৫২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। বিএনপি নেতা নাঈম হোসেনসহ ১৭ জন ৭ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর পর থেকে তাঁরা কারাগারে আছেন।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরখান থানায় করা মামলায় গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির ৩২ নেতা-কর্মীর আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। জাহাঙ্গীর আলম ব্যাপারীসহ ১২ জন গত ১০ মার্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে সবাই জামিনে মুক্তি পান। 

বিএনপির নেতা-কর্মীদের আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মাধ্যমে অন্তত ২৫ দণ্ডিত নেতা-কর্মী আত্মসমর্পণ করে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। আরেক আইনজীবী মোহাম্মদ আমীরুল ইসলাম বলেন, তাঁর মাধ্যমে অন্তত ৩০ দণ্ডিত নেতা-কর্মী জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। 

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই থেকে তিন মাস আগে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা হয়। বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার না পাওয়ায় সাজাপ্রাপ্ত নেতারা উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। আপিলের শর্তে অনেকে জামিন পাচ্ছেন। 
বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন

দণ্ডিত শীর্ষ নেতারা জামিনে

আইনজীবী ও আদালত–সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির তিনজন ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা, দুজন যুগ্ম মহাসচিবসহ দলটির ৩১ কেন্দ্রীয় নেতার সাজা হয়। তাঁদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ২৬ জন জামিনে আছেন। বাকি ৫ জন কারাগারে।

বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই থেকে তিন মাস আগে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা হয়। বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার না পাওয়ায় সাজাপ্রাপ্ত নেতারা উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। আপিলের শর্তে অনেকে জামিন পাচ্ছেন। 

রায়ের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে গত বছরের ২০ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলমের সাতটি মামলায় ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন। তাঁর আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সাজার মামলায় জামিন পেলেও একের পর এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোয় তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না।

সাইফুলের পর সর্বোচ্চ ছয়টি মামলায় সাজা হয়েছে যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের। তাঁর আইনজীবী মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইসহাক আত্মসমর্পণের পর জামিনে আছেন। 

জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখার জন্য গত বছরের আগস্টের পর একের পর এক রাজনৈতিক মামলায় নেতা–কর্মীর সাজা হয়। অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত নেতা–কর্মীদের অনেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এখন অনেকে আত্মসমর্পণ করছেন। কেউ কেউ জামিন পাচ্ছেন। অনেককে রোজ ঘুম থেকে উঠে মামলার হাজিরা দিতে আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

বেশি রায় ডিসেম্বরে

আইনজীবী ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৪০টি মামলায় রায় হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে ৮০টি, নভেম্বরে ৪৫টি, অক্টোবরে ৯টি, আগস্টে ২টি এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪টি মামলায় রায় হয়। নিষ্পত্তি হওয়া এসব মামলার মধ্যে ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ ৮৪টি মামলা হয়েছিল। বেশির ভাগ মামলায় বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কাজে বাধা ও হামলা, যানবাহন ভাঙচুর, আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ ছাড়া গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর দলটির মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের অনেকে পরে জামিনে মুক্তি পান।

মামলার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখার জন্য গত বছরের আগস্টের পর একের পর এক রাজনৈতিক মামলায় নেতা–কর্মীর সাজা হয়। অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত নেতা–কর্মীদের অনেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এখন অনেকে আত্মসমর্পণ করছেন। কেউ কেউ জামিন পাচ্ছেন। অনেককে রোজ ঘুম থেকে উঠে মামলার হাজিরা দিতে আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে।