খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা
সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় পরিবার
খালেদা জিয়াকে অল্প দিনের ব্যবধানে গতকাল তৃতীয়বারের মতো সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল।
সাড়ে তিন ঘণ্টা সিসিইউতে রাখার পর গত রাতেই কেবিনে নেওয়া হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৫২ দিন ধরে ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অল্প দিনের ব্যবধানে গতকাল বিকেলে তৃতীয়বারের মতো করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়েছিল। এ তথ্য নিশ্চিত করে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার শ্বাসকষ্টের সমস্যার কারণে গতকাল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা তাঁকে সিসিইউতে রাখা হয়েছিল।
৫২ দিন ধরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে আবেদনের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার কথা বলছে তাঁর পরিবার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নেত্রীর পরিবারের আবেদনের ব্যাপারে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে আগামীকাল রোববার তিনি আইনগত মতামত দেবেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বিএনপি নেত্রীর পরিবারের আবেদনের ব্যাপারে আগামীকাল রোববার তিনি আইনগত মতামত দেবেন।
যদিও আইনগত মতামত দেওয়ার আগে এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি আইনমন্ত্রী। তবে গত সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খালেদা জিয়া শর্তযুক্তভাবে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে মুক্ত রয়েছেন। আইনের এই বিদ্যমান অবস্থানে সরকারের পক্ষে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও কয়েকজন মন্ত্রীও একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। তাঁরা আইনগত জটিলতার কথা বলে আসছিলেন। মন্ত্রীরা এ–ও বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন করা হয়নি।
এমন পটভূমিতে ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন তাঁর ছোট ভাই শামীম ইসকান্দার। সেই আবেদনই এখন আইন মন্ত্রণালয়ে মতামতের অপেক্ষায় রয়েছে।
খালেদা জিয়ার পরিবারের একজন সদস্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবেদনের ব্যাপারে তাঁরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেবে বলে তাঁরা আশা করছেন। আর সরকারের অনুমতি পেলে যাতে দ্রুত বিদেশে পাঠানো যায়, সে জন্য তাঁরা জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর—এই চার দেশের হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছেন।
বিএনপি নেত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার দাবিতে বিএনপি এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিও নিচ্ছে। এই দাবির পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গতকাল ঢাকায় জাতীয়তাবাদী মহিলা দল একটি সমাবেশ করেছে। সেই সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, তাঁদের নেত্রীর পরিবারের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
তবে খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে এখনই সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেবে, এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি সরকারি কোনো সূত্র থেকে। সরকারের একাধিক সূত্র বলেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে আইনগত দিক থেকে সরকারের কিছু করার নেই বলে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য আগে দিয়েছেন, সরকার সেই অবস্থানেই রয়েছে। গত সপ্তাহে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও মুক্তির ব্যাপারে সরকারের নির্বাহী আদেশ বাতিল করে তিনি যদি আগের অবস্থানে ফেরত আসেন, তখন অন্য বিষয় বিবেচনার প্রশ্ন আসতে পারে।
সরকারের এমন অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, সে ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের একটি প্রভাবশালী সূত্র বলেছে, বিএনপি যেহেতু সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনে আছে এবং এমন পরিস্থিতিতে সরকার নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। ফলে বিএনপি নেত্রীর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির বিষয়টি দলটির সঙ্গে সমঝোতার জন্য একটি কার্ড হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ সরকারের হাতে রয়েছে।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের অনেকে মনে করেন, আইনগত জটিলতার কথা বলা হচ্ছে রাজনৈতিক চিন্তা থেকে। সরকার চাইলে আদালতে না গিয়ে তাঁকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিতে পারে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্ন আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
সিসিইউতে সাড়ে তিন ঘণ্টা
গত ৯ আগস্ট থেকে ৫২ দিন ধরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। চিকিৎসক জাহিদ হোসেন গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে শুক্রবার বিকেলে তাঁকে কেবিন থেকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। এর আগেও গত দুই সপ্তাহে খালেদা জিয়াকে শ্বাসকষ্টের কারণে দুই দফায় সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল।
জাহিদ হোসেন জানান, গতকাল বিকেলে শ্বাসকষ্ট হওয়ায় খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে নিতে হয়েছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা চিকিৎসা দেওয়ার পর তাঁর শ্বাসকষ্ট কমে যায়। তখন আবার গত রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে কেবিনে নেওয়া হয়।
বিএনপি নেত্রীর মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তাঁর লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তাঁর স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এ কারণে তাঁকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে এবং কখনো কখনো তাঁকে সিসিইউতে নিতে হচ্ছে।
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দী ছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। এরপর ছয় মাস পরপর তাঁর সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। গত মার্চ মাসে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়।
সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।