প্রয়োজনে আরেকটি বিপ্লব হবে, কাউকে আর ‘ফ্যাসিস্টের’ ভূমিকায় ফিরতে দেওয়া হবে না

জাতীয় নাগরিক পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুবশক্তি আয়োজিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যুব আলেমদের অবদান’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত অতিথিরা। আজ শুক্রবার রাজধানীর বাংলামোটরেছবি: প্রথম আলো

গণ-অভ্যুত্থানে অন্যদের সঙ্গে আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা রক্ত দিয়ে দেশকে ‘ফ্যাসিস্ট’মুক্ত করেছে। আবার কেউ যাতে বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিস্টের’ ভূমিকায় ফিরতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনে আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁরা।

আজ শুক্রবার রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুবশক্তি আয়োজিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যুব আলেমদের অবদান’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। জুলাই অভ্যুত্থানে অংশে নেওয়া বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেম-ওলামারা এই সেমিনারে অংশ নেন।

জুলাই আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলার কথা বলেন আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক ও লেখক ফোরামের সভাপতি মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী। তিনি বলেন, ‘আলেমরা দেশের সংকটকালে মাঠে নেমেছেন, আন্দোলন করেছেন। কিন্তু সেই ইতিহাস কোথাও লেখা হয়নি। প্রতিবারই আন্দোলনের ফসল চুরি হয়ে গেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আলেমদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, এবার আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে হবে।’

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী সে সময় গণমাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কলম ধরার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘১৫ বছর ধরে প্রথম আলোতে লেখা পাঠাই তারা ছাপায়, কখনো ফোন দেয়নি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় লেখা দেখে ফোন দিয়ে প্রশংসা করে বলল, বারুদ লিখেছেন। আমি বলেছি, ছাপার সুযোগ থাকলে ছাপেন। তারা ছেপেছে। ছাপার হিম্মত দেখিয়েছে।’

নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার বলেন, ‘আমরা ২০১৩ সালে রক্ত দিয়েছি, ২০২১ সালে রক্ত দিয়েছি, ২০২৪ সালে রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ফাসিস্টমুক্ত করেছি। কিন্তু এখন আবার অনেকে ফ্যাসিস্টের সেই ভূমিকায় ফিরে যেতে চাইছে। প্রয়োজনে আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত হবে, তবু কাউকে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় ফিরতে দেওয়া হবে না।’

সেমিনারে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন না হলে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যেত। আলেমরা–মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছেন, রক্ত দিয়েছেন, মাদ্রাসার শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আমরা আলোচনা করে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভাগ ভাগ করে আন্দোলনে নামিয়েছি। সকল রকমের সহায়তা করেছি। আমাদের এই আন্দোলন বৃথা যাওয়ার জন্য নয়।’ ভবিষ্যতে যাতে কোনো জালিম শক্তি ক্ষমতায় যেতে না পারে, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকে আলেমরা রক্ত দিয়ে আসছেন, এই গণ-অভ্যুত্থানেও আমরা আলেমরা রক্ত দিয়েছি। আমাদের অবদান ভুলে গেলে চলবে না। আমরা বারবার রক্ত দিয়েছি, এবার আর রক্ত দেব না, প্রতিশোধ নেব।’ সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো মানুষকে এভাবে হত্যা করে ক্ষমতায় যাবেন, পার পেয়ে যাবেন, তা হবে না। মানুষ জেগে উঠলে আওয়ামী লীগের মতো পালানোর পথ পাবেন না।’

সেমিনারে প্রধান আলোচকের বক্তব্যে খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মুফতি আহমেদ কাসেমী বলেন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল আলেম-ওলামাদের কোনো ভূমিকাকে স্বীকার করতে চায় না। অথচ যখনই সংকট তৈরি হয়, তখনই আলেমরা আন্দোলনের মাঠে গেছেন। রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তিনিও সতর্ক করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাঁরা ক্ষমতায় যাবেন, আপনারা মনে করবেন না জুলাই যোদ্ধারা হারিয়ে যাবে। যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আলেমরা দেশের প্রয়োজনে যুবকদের পাশে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।’

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে আলেমরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে বহু আলেম শহীদ হয়েছেন, ২০২১ সালে মোদি (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) বিরোধী আন্দোলনে অনেকে জীবন দিয়েছেন। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের কোনো তালিকা নেই। তাঁদের কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের করালগ্রাসে যেসব যুব–আলেম জীবন হারিয়েছেন, তাঁদের কথা আমরা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরতে চাই, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমরা মনে করি, তাঁদের এই আত্মত্যাগকে জাতির সামনে উন্মোচিত করতে হবে।’

আলেমদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা হয় মন্তব্য করে তরিকুল ইসলাম বলেন, তাঁদের শুধু মসজিদ ও মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। অথচ তাঁদের নেতৃস্থানীয় জায়গায় যাওয়া দরকার ছিল। তিনি বলেন, ‘যুব–আলমেরা সমাজের নেতৃস্থানীয় জায়গাগুলোতে নেতৃত্ব দেবেন। তাঁরা শুধু ইসলাম ও ধর্মের কথা বলবেন না, তাঁরা এ বাংলাদেশের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও কথা বলবেন।’

বিএনপি স্বৈরাচার হওয়ার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, আগে যেখানে আওয়ামী লীগ চাঁদাবাজি করত, এখন সেখানে বিএনপি চাঁদাবাজি করে। চাঁদার জন্য তারা মানুষকে পাথর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। বিএনপি সংস্কারপন্থী দল নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার জন্য বিএনপি নির্বাচন নির্বাচন জপছে।

সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় যুবশক্তির সদস্যসচিব জাহেদুল ইসলাম ও মুখ্য সংগঠক ফরহাদ সোহেল, যুবশক্তির আলেম প্রতিনিধি মাওলানা ইদ্রিস, যাত্রাবাড়ীর প্রতিনিধি সাকিবুল ইসলাম, মোহাম্মদপুর প্রতিনিধি ফয়সাল আহাম্মেদ প্রমুখ।