নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে ইসির ব্যাখ্যায় বিভ্রান্তি

যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁরা এখন নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন কি না, সেটি নিজেদের ব্যাখ্যায় পরিষ্কার করেনি ইসি।

নির্বাচন ভবন
ফাইল ছবি

নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে আচরণবিধির একটি ব্যাখ্যা গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে ইসির ব্যাখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ইসি বলেছে, ১৮ ডিসেম্বরের আগে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। ফলে এর আগে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই।

কিন্তু বিভিন্ন দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁরা এখন নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন কি না, সেটি পরিষ্কার করেনি ইসি। কারণ, ইসির ভাষায় এখন পর্যন্ত ‘আইন ও আচরণবিধির অর্থে প্রার্থী নন’ তাঁরা। যদিও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় একাধিক প্রার্থীকে (মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া) শোকজ ও সতর্ক করা হয়েছে।

ইসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের টক শো বা পত্রপত্রিকায় মন্তব্য করছেন যে নির্বাচন কমিশন আচরণবিধিমালা প্রয়োগের বিষয়ে নির্লিপ্ত। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিশিষ্টজনদের এমন মনগড়া বক্তব্য জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে। সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা বিনষ্টের মাধ্যমে তা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যা মোটেই কাম্য নয়। এ কারণে আইন ও বিধির প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরার জন্য গতকাল ওই ব্যাখ্যা দিয়েছে ইসি।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনী সব আইন ও আচরণবিধি প্রযোজ্য হয়।
এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার

আচরণবিধিমালার ধারা উল্লেখ করে গণমাধ্যমে পাঠানো ইসির ব্যাখ্যায় বলা হয়, নির্বাচনী আচরণবিধির মূল বিষয় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী। প্রার্থী দলের পক্ষে মনোনীত হতে পারেন বা স্বতন্ত্র হতে পারেন। প্রার্থীরা প্রচারণার জন্য ২১ দিনের বেশি সময় পাবেন না।

ইসি বলেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার আগপর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনীত বা স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী আইন ও আচরণবিধির অর্থে প্রার্থী নন। নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ হবে কোনো নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করে প্রতীক বরাদ্দ করে প্রচারণার জন্য মাঠ উন্মুক্ত করার পর। সে সময় থেকে তাঁদের ক্ষেত্রে আচরণবিধিমালা প্রযোজ্য হবে। আচরণবিধি অনুযায়ী, ২১ দিন আগে (ভোট গ্রহণের) কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা নিষিদ্ধ। প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের সময় ১৮ ডিসেম্বর থেকে আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বরের আগে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। ফলে এর আগে কোনো নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণারও সুযোগ নেই।

এর আগে গত রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, নির্বাচনী আচরণবিধিমালা প্রয়োগের সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর আচরণবিধিমালা প্রযোজ্য হবে। এখন লাঙ্গল, নৌকা বা নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে প্রচার চালাতে কোনো রাজনৈতিক দলের বাধা নেই।

তবে এর মধ্যে ইসি কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযুক্ত করেছে। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর বুধবার গাড়িবহর নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় যান ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। সেখানে তিনি নাগরিক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজের জন্য এবং আওয়ামী লীগের জন্য ভোট চান।

পরদিন সাকিবকে শোকজ (কারণ দর্শানো) করে ইসির গঠন করা মাগুরা-১ নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এর আগে গত ২২ নভেম্বর রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে সতর্ক করতে নির্দেশনা দেয় ইসি।

এখনো আচরণবিধি প্রয়োগের সময় না হলে কীভাবে এই সংসদ সদস্যকে সতর্ক করেছে ইসি, রোববার এ প্রশ্ন ছিল সিইসির কাছে। তিনি এর কোনো জবাব দেননি।
৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে শোকজ করা হয়েছে। অবশ্য আচরণবিধি অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শোডাউন বা মিছিল করা যায় না।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় গতকালও নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি নারয়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী লিয়াকত হোসেনকে শোকজ করেছে।

নির্বাচনী আচরণবিধিমালা প্রথম করা হয়েছিল ২০০৮ সালে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের আমলে। ওই কমিশনে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা (আচরণবিধির বিষয়ে) নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে তাঁদের সময় যেভাবে আচরণবিধি করা হয়েছিল, তা পরের দুটি নির্বাচন কমিশনও বাস্তবায়ন করেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনী সব আইন ও আচরণবিধি প্রযোজ্য হয়।

আচরণবিধি যদি এখন প্রযোজ্য না হয়, তাহলে সাকিব আল হাসানকে কেন শোকজ করা হলো, এমন প্রশ্ন তুলে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, এখন সবাই প্রচার চালাতে পারবে, নির্বাচন কমিশন এটি বলে দিলেই পারে।