সংলাপের দায়িত্ব নেবে কে, বুঝতে চায় আওয়ামী লীগ–বিএনপি

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ, তা বলছে না। তবে তারা নিজেরা সংলাপের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকা সফরের সময় তা পরিষ্কার করে বলেছেন। দেশের নাগরিক সমাজও আলাপ–আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ দিচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিও সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ তা বলছে না। তবে সংলাপের উদ্যোগ বা দায়িত্ব কে নেবে—এ বিষয়ে দুই দলই জানা ও বোঝার চেষ্টা করছে। যদিও এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু বলছে না বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া সংলাপ প্রশ্নে তারা নিজ নিজ দলে এখনো আলোচনা শুরু করেনি বলেও দল দুটির নেতারা বলছেন।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরের শেষ দিনে গত বৃহস্পতিবার দফায় দফায় একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, এই বার্তা তাদের দেওয়া হয়েছে।

আব্দুর রাজ্জাক
সংবিধান মেনে নির্বাচনে অংশ নেবে—এমন ঘোষণা দিক বিএনপি। এরপর আলোচনা হতে পারে।
আব্দুর রাজ্জাক,  সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ

পাশাপাশি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে জোর দিয়েছে। ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলও বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ব্যাপারে কথা বলেছে। তবে রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর দুই রাজনৈতিক শিবির। সংলাপ প্রশ্নে তারা নিজ নিজ দলে এখনো আলোচনা শুরু করেনি। এমনকি দুই পক্ষই মনে করছে, যার যার অবস্থান থেকে এ পর্যায়ে সরে এলে রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ভয় আছে। তাই ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা সংলাপের ব্যাপারে কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। এমনকি তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও নেই।

মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া
ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সফর, বৈঠক, আলোচনাকে নির্বাচনের আগে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। দলটির উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত বিদেশি কেউ তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দরকার—এ বিষয়ে স্পষ্ট করে সরকার বা আওয়ামী লীগকে কিছু বলেননি। তাঁরা শুধু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলছেন। আওয়ামী লীগও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করছে তাঁদের। ফলে আওয়ামী লীগ সংলাপের বিষয়ে চাপ অনুভব করছে না।

তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে—এমন একটি তাগিদ হয়তো একপর্যায়ে আসতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, এ দুটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংলাপ করতে রাজি নয়। কারণ, সংলাপে এ দুটি বিষয় এলেই রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের একধরনের পরাজয় হয়ে যাবে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও মতে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন—এমন বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নিয়ে সংলাপ করা হলে ভোটের আগেই হেরে যাবে আওয়ামী লীগ। ফলে এ দুটি বিষয় নিয়ে দলটি কোনো সংলাপে রাজি নয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ফাইল ছবি
আলোচনা বা সংলাপ তখনই হবে, যখন নির্দলীয় সরকার মেনে নেওয়া   হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এমন প্রেক্ষাপটে সংলাপ প্রশ্নে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি প্রথমে বুঝতে চায় সংলাপ কী নিয়ে হবে? দ্বিতীয়ত, এই সংলাপের উদ্যোগ বা দায়িত্ব কে নেবে? আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ চায় না। তবে বিএনপিকে সংবিধান মেনে নির্বাচনে আনার বিষয়ে কেউ দায়িত্ব নিলে তাদের সঙ্গে সংলাপে রাজি আছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রশ্নে বিএনপির অন্য কোনো দাবিদাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি ঢাকা সফরের সময় সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের যে কথা বলেছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে চায়। এ অবস্থায় তাদের সঙ্গে কিসের সংলাপ হবে? সংবিধান মেনে নির্বাচনে অংশ নেবে—এমন ঘোষণা দিক বিএনপি। এরপর আলোচনা হতে পারে।’

আরও পড়ুন

অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি থেকে তাদের সরে আসার আর সুযোগ নেই। দলের কর্মী-সমর্থকেরাও তা মেনে নেবেন না। এ পর্যায়ে আগবাড়িয়ে দলের কেউ কথা বললে উল্টো রোষানলে পড়ার আশঙ্কা আছে।

আগের দুটি নির্বাচনের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনায় বিএনপি এবারের পরিস্থিতিকে তাদের অনুকূলে বলে মনে করছে। দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির মিত্রের সংখ্যা বেড়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিদেশিদের নানা ধরনের তৎপরতার কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অনেকটাই চাঙা। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য এটাকেই সেরা সময় মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। ফলে এ মুহূর্তে রাজপথে সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করে এগোনোর পক্ষে তাঁরা।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আলোচনার মাধ্যমে যদি সমাধান না করে, তাহলে সংঘাত হবে। এমন পটভূমিতে দুই দল সংলাপে বাধ্য হবে বলে তিনি মনে করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার

বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন বিতর্কিত করে সরকারই বেকায়দায় আছে। এ অবস্থায় সংলাপের উদ্যোগ নিতে হলে সরকারকেই নিতে হবে। তারা বিরোধীদের দাবি কীভাবে মেনে নেবে, কীভাবে বিরোধীদের আশ্বস্ত করবে—এই দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।

কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের বিষয়টি এখন সামনে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকা সফরের সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং সংলাপের কথা পরিষ্কার করে বলেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনা বা সংলাপ তখনই হবে, যখন নির্দলীয় সরকার মেনে নেওয়া হবে। দাবি মানার পর নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের মডেল বা রূপরেখা কী হবে, সেটি নিয়ে সংলাপ হতে পারে। এ ছাড়া সংলাপ করে কোনো লাভ নেই। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করেছে। ২০১৮ সালে সংলাপ করেও লাভ হয়নি।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা এখন পর্যন্ত তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রকাশ্যে যে অবস্থান তুলে ধরছেন, তাতে তাঁদের কেউ নিজেরা সংলাপের দায়িত্ব নিতে রাজি নন। দুই দলেরই প্রশ্ন সংলাপের বিষয় নিয়ে। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সংলাপে রাজি নয়। আর শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তখন সংলাপে যেতে পারে আওয়ামী লীগ।

 নির্বাচনের ছয় মাস আগে দুই দল যার যার অবস্থান থেকে ছাড় দিতে রাজি নয় বা নমনীয় হচ্ছে না।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে দুই দলের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতার কারণেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটা চাপ অনুভব করছে। এর প্রভাবে দেখা গেছে, গত বুধবার দুই দল ঢাকায় অল্প দূরত্বে দুটি সমাবেশ করেছে।

কিন্তু পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকলেও দুই পক্ষের কেউই উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়িত্ব নিতে চাইছে না। ফলে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিদেশি চাপ বাড়তে পারে এবং তার প্রভাবে আলোচনার প্রশ্নে দুই দলের মনোভাবেরও পরিবর্তন হতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আলোচনার মাধ্যমে যদি সমাধান না করে, তাহলে সংঘাত হবে। এমন পটভূমিতে দুই দল সংলাপে বাধ্য হবে বলে তিনি মনে করেন।