রাজবাড়ীতে নিজেদের মধ্যে লড়াই আওয়ামী লীগের

প্রায় ভোটারশূন্য মৈশালা দারুল উলুম মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্র। পাংশা, রাজবাড়ী, ৮ মে, ২০২৪ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার মৈশালা দারুল উলুম মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রের একটি নারী বুথে ভোটার ৪৩২ জন। গতকাল বুধবার সকাল আটটায় ভোট শুরুর পর বেলা একটা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টায় বুথটিতে ভোট পড়েছিল ৪২টি, ভোটের হার ৯ দশমিক ৭। এই উপজেলা নির্বাচনে কমবেশি প্রায় সব কেন্দ্রের চিত্র ছিল এমনই।

উপজেলার অন্তত ১২ জন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না থাকার কারণে ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না। ভোটকেন্দ্রে যাঁরাই ভোট দিতে এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন প্রার্থীদের সমর্থক, অনুসারী বা কর্মী। তবে দুজন ‌‌‘শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী’ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ভোট নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা থাকলেও দিন শেষে ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ।

আরও পড়ুন

এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একজন বতর্মান চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান (ওদুদ)। আগের মেয়াদেও তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রতীক আনারস। গত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। সেই নির্বাচনে রেলমন্ত্রী ও রাজবাড়ী–২ আসনের (পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী) সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন বলে আলোচনা ছিল।

চেয়ারম্যান পদে আরেক প্রার্থী খন্দকার সাইফুল ইসলাম মাছপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাঁচবারের চেয়ারম্যান। ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি এবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। তাঁর প্রতীক মোটরসাইকেল। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এবার তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। এই প্রার্থীর পক্ষে রেলমন্ত্রীর ছেলে আশিক মাহমুদ ও আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা-কর্মীরা প্রচারে সরব ছিলেন।

নির্বাচনের আগে আলোচনা ছিল, যেহেতু রেলমন্ত্রী চেয়ারম্যান পদে সাইফুল ইসলামকে সমর্থন দিয়েছেন, নির্বাচনের দিন সাইফুলকে জেতাতে সব শক্তি ব্যবহার করবেন তিনি। অবশ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এই উপজেলায় সংঘাতের আশঙ্কাও করেছিলেন কেউ কেউ। তবে ভোটের সময় ও ভোটের ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত এই দুই প্রার্থীর কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া এই উপজেলায় বড় ধরনের সহিংসতা হয়নি। পাশাপাশি দৃশ্যমান বড় কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। তবে একটি কেন্দ্রে মোটরসাইকেল প্রতীকের পক্ষে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আরেকটি কেন্দ্রে মোটরসাইকেল প্রতীকের এজেন্ট ভোটারদের ভোট দিয়ে দিচ্ছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাংশা পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল আল মাসুদ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। তীব্র গরমের মধ্যে ভোটাররা এসেছেন, এটাই বা কম কি।

তবে পাংশা উপজেলার জশাই ইউনিয়নের বাসিন্দা ভ্যানচালক আনোয়ার হোসেন মনে করেন, সব দল নির্বাচনে না থাকলে তো মানুষজন কেন্দ্রে যাবেন না। অবস্থাও তা–ই হয়েছে। আর মৌরাট ইউনিয়নের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন নিয়ে যতটা আওয়াজ ছিল তার কিছুই হয়নি, মানুষজনও ভোটকেন্দ্রে যাননি।

এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা উঠান বৈঠক করেছেন, শোডাউন করেছেন; কিন্তু ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাননি। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। আবার অনেকে বলছেন, ঘুরেফিরে একটি দলের কেউ না কেউ ভোটে জয়ী হবেন, এমন ধারণা থেকেও সাধারণ ভোটারের আগ্রহ ছিল না।

জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা

গতকাল পাংশা উপজেলার অন্তত ১২টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক। সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকেই কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল না। যাঁরাই আসছেন, নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্য ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যদিও এটি নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন।

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মৈশালা দারুল উলুম মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থীর এজেন্টের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভোট দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন আনারস প্রতীকের পোলিং এজেন্ট। অন্যের ভোট দিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বুথে থাকা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হাশমত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ঘটনা দুটি ঘটেছে। বিষয়টি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।’

পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবু বকরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর কাছে অভিযোগ আসার পর তিনি মোটরসাইকেল প্রতীকের পোলিং এজেন্টদের সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে পাট্টা ইউনিয়নের নিভা গুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে শোনা যায়, কেন্দ্রটিতে মোটরসাইকল প্রতীকের পক্ষে জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে। পরে সেখানে গিয়ে সাংবাদিকেরা জাল ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ানো দুজন কিশোরকে ধরিয়ে দেন।

পাংশা উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ১৬ হাজার ১০০ জন। ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত পাংশা উপজেলায় ভোটকেন্দ্র ৫০টি।

এই উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।