সিপিবির নেতৃত্ব বদলের পেছনে কী
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে নির্বাচিত হয়েছে নতুন সভাপতিমণ্ডলী। আট সদস্যের এই সভাপতিমণ্ডলীতে বিদায়ী কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক নেই। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে তাঁদের না থাকাটা রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি করেছে।
সিপিবির নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন আর সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন ২০০৯ সাল থেকে সিপিবির গণসংগঠন কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আর ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি ক্বাফী রতন সিপিবির বিদায়ী কমিটিতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি।
এই দুজনের সঙ্গে সিপিবির নতুন সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সভাপতিমণ্ডলীর বাকি সদস্যরা হলেন রফিকুজ্জামান, এস এ রশীদ, রাগিব আহসান, জলি তালুকদার ও আমিনুল ফরিদ।
বিদায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ আছেন ৪৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সিপিবির এই তিন নেতার নাম উল্লেখ করে সাবেক এক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর বিভক্তির সিরিজ অধ্যায় রুখে দেওয়ার ইতিহাস হয়ে থাকবেন তাঁরা।
সিপিবির চার দিনব্যাপী ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধন হয় ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। ২২ সেপ্টেম্বর রাতে কাউন্সিলরদের ভোটে ৪৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস শেষ হয়।
সংশ্লিষ্ট সিপিবি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির ৪৩টি সদস্যপদের জন্য ৭৬ জন প্রার্থী হয়েছিলেন। এই প্রার্থীরা মূলত দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিলেন। এক পক্ষে ছিলেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নবনির্বাচিত সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, জলি তালুকদারসহ অন্যরা। অপর পক্ষে ছিলেন বিদায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, দিবালোক সিংহ, শাহীন রহমান, সাজেদুল হক, লুনা নূর, মানবেন্দ্র দেব, লাকী আক্তারসহ অন্যরা।
সারা দেশের সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলো থেকে প্রতিনিধি হয়ে আসা ৫২৫ জন ভোট দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচিত করেন। তাঁদের মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাজ্জাদ জহির চন্দন ও ক্বাফী রতনদের পক্ষের রয়েছেন ২৭ জন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেয়।
২৪ সেপ্টেম্বর (বুধবার) রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভা হয়। সেখানে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নতুন কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনের নাম প্রস্তাব করেন। এ সময় সভাপতি পদে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মোহাম্মদ শাহ আলম ও রুহিন হোসেনের নাম আলোচনায় আসে। সাধারণ সম্পাদক পদে বিদায়ী কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষের নাম প্রস্তাব করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন।
ওই সভায় উপস্থিত একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনের একটি বক্তব্য তুলে ধরে সাধারণ সম্পাদক পদে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে আপত্তি তোলেন কয়েকজন নেতা। ওই ভিডিওতে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনকে বলতে শোনা যায়, ‘ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ জনের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। তারা এই সংবিধান প্রণয়ন করেছে। ড. কামাল হোসেন সাহেব এটা ব্রিফকেসে ভরে, বাংলাদেশের মানুষের সাথে আলাপ করেননি, চলে গেছেন লন্ডনে। লন্ডনে গিয়ে এটাকে ভেটিং করিয়েছেন, আমাদের জনগণ দ্বারা ভেটিং হয় নাই, ভেটিং হয়েছে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী কর্তৃক। এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৯০ বছর ধরে আমরা লড়াই করেছি এবং গোপনে এটা ভারত থেকে ভেটিং হয়েছে কি না, সেটা কিন্তু আমরা জানি না।’
সভায় সাধারণ সম্পাদক পদে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনের বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দেন অন্তত ১০ জন। তবে সভায় আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনদের পক্ষে বেশি সদস্য থাকায় একপর্যায়ে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন মিহির ঘোষ। এরপর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন ও আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন নির্বাচিত হন।
এরপর নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নয় সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর নাম প্রস্তাব করেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে বিদায়ী কমিটির সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেনের নামও প্রস্তাব করা হয়। তবে রুহিন হোসেন সেখানে মিহির ঘোষ ছাড়া বিদায়ী কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাহীন রহমানের নামও প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে রুহিন হোসেন সভাপতিমণ্ডলী থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন। এরপর বিদায়ী সভাপতি শাহ আলমও নাম প্রত্যাহার করে নেন। তখন সিপিবির বগুড়া জেলার সভাপতি আমিনুল ফরিদকে অন্তর্ভুক্ত করে আট সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচিত হয়।
সভাপতিমণ্ডলীর আট সদস্যের বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: ১. মোহাম্মদ শাহ আলম, ২. রুহিন হোসেন, ৩. মিহির ঘোষ, ৪. শাহীন রহমান, ৫. লক্ষ্মী চক্রবর্তী, ৬. পরেশ কর, ৭. অনিরুদ্ধ দাশ, ৮. আনোয়ার হোসেন, ৯. কাজী রুহুল আমীন, ১০. সাজেদুল হক, ১১. লুনা নূর, ১২. আবিদ হোসেন, ১৩. ফজলুর রহমান, ১৪. এম এম আকাশ, ১৫. মৃণাল চৌধুরী, ১৬. মন্টু ঘোষ, ১৭. দিবালোক সিংহ, ১৮. এমদাদুল হক মিল্লাত, ১৯. মনিরা বেগম, ২০. মনোজ দাশ, ২১. মো. কিবরিয়া, ২২. আসলাম খান, ২৩. নিমাই গাঙ্গুলী, ২৪. লাকী আক্তার, ২৫. মানবেন্দ্র দেব, ২৬. সাদেকুর রহমান শামীম, ২৭. এস এম শুভ, ২৮. আহসান হাবিব, ২৯. মহসিন রেজা, ৩০. সুব্রতা রায়, ৩১. রেবেকা সরেন, ৩২. সাজিদুল ইসলাম, ৩৩. মঞ্জুর মঈন, ৩৪. এস এম শহীদুল্লাহ ও ৩৫. সুকান্ত শফি চৌধুরী।
দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব কোথায়?
কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর অপর পক্ষের নেতাদের সভাপতিমণ্ডলীতে না থাকার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে থাকা দলটির নেতাদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হতে শুরু করে বেশ কয়েক বছর আগে। ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ সময় তাঁর নেতৃত্বে দলটি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে। টানা দুই দফায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০২২ সালে সিপিবির দ্বাদশ কংগ্রেসে তাঁর সভাপতি হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাঁকে আবার সভাপতি করতে ওই কংগ্রেসে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনার প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও ভোটে তা আটকে যায়।
ওই সম্মেলনে অধ্যাপক এম এম আকাশ ও ডা. দিবালোক সিংহের নেতৃত্বাধীন একটি পক্ষ সামনে আসে। প্রতিনিধিদের ভোটে তাঁদের পক্ষের নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন বেশি। ওই পক্ষ থেকে মনোনীত হয়ে সিপিবির সভাপতি হন মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক হন রুহিন হোসেন।
এর পর থেকে দলটি নতুন নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে এলেও নেতাদের মধ্যে দুই পক্ষে অবস্থান চলতে থাকে। সিপিবির নেতৃত্বে বিভাজনের প্রভাব পড়ে গণসংগঠনে। ছাত্র ইউনিয়নে পাল্টাপাল্টি কমিটি হয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে। উদীচীতেও দেখা দেয় বিভক্তি।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পক্ষের নেতারা বিদায়ী কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ঘাটতিসহ নানা অভিযোগ তোলেন। তাঁদের কারও কারও মতে, বিদায়ী কমিটির নেতাদের কারণে সিপিবি গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে ওই নেতাদের কারও কারও আওয়ামী লীগের বিষয়ে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে বলে দাবি করেন তাঁরা।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে সিপিবির বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘হ্যাঁ, এ ধরনের অভিযোগ অনেক সময় কেউ কেউ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু আমরা পরিষ্কারভাবে দ্বাদশ কংগ্রেসে আমাদের যে দায়িত্ব, সে অনুযায়ী কাজ করেছি। দ্বাদশ কংগ্রেস আমাদের বলেছিল, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় কোটাবিরোধী আন্দোলন বা এ ধরনের জনপ্রিয় আন্দোলনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অবস্থান থাকে। তাই স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখে আমাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
সেই জায়গা থেকে সিপিবি জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে রুহিন হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ঘাটতি বলে, তবে তা যথাযথ হয় না। শক্তি সমাবেশ ঘটাতে পারলে আরও বেশি ভূমিকা নিতে পারতাম, তা আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির মূল্যায়নেই বলেছি।’ গত বছর আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি করার পর সিপিবিই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সিপিবি নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ খুব বেশি নেই বলে মনে করেন গত ছয়টি কংগ্রেসে অংশ নেওয়া দলটির নড়াইল জেলা কমিটির সভাপতি বি এম বরকত উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিপিবির নেতাদের মধ্যে দুই পক্ষে অবস্থানের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্য হয় দ্বাদশ কংগ্রেসে। তখন এম এম আকাশ ও ডা. দিবালোক সিংহের সঙ্গে নেতারা বিপুলভাবে পার্টি কমরেডদের সমর্থন পান। এবার অনেকটা তার উল্টো হয়েছে।’
তবে সিপিবিতে বর্তমানে কোনো বিরোধ বা পক্ষ নেই বলে দাবি করেছেন নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিরোধের জায়গাটা আসলে আমরা সমাধান করে ফেলেছি। কংগ্রেসে আমাদের যে দুটো রাজনৈতিক প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো আমরা সমাধান করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের দুটো রাজনৈতিক প্রস্তাবকেই ছয় সদস্যের একটি কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রস্তাবে রূপান্তর করব।’
কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় তাঁর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বিষয়ে বেশ কয়েকজন নেতার আপত্তি করা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ‘এই কংগ্রেসে নয়জন সম্ভবত নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। তাঁরা কিন্তু বিপক্ষে ভোট দেন নাই। ভোট করেন নাই। মানে তাঁদের আমার বিষয়ে আপত্তি ছিল, সে জন্য এটি দিয়েছেন। এটা আমরা গ্রহণ করেছি।’
সিপিবির বিদায়ী কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সভাপতিমণ্ডলীতে নেই কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওনাদের নাম আসলে প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু ওনারা নিজেরাই থাকতে চাননি। আশা করি, আমরা পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় তাঁদের ফিরে পাব।’